সিরিয়ার ইতিহাসে বাশার আল-আসাদের শাসন এক বিতর্কিত অধ্যায়। ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি তার পিতা হাফিজ আল আসাদের শাসনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। শুরুর দিকে কিছু সংস্কারের আভাস দিলেও পরে তার শাসন হয়ে ওঠে দমনমূলক। গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনে টিকে থাকা—তার শাসনকাল নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় আকীর্ণ। চলুন, তার শাসনের দশটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
২০০০ সালের ১৭ জুলাই: পিতার উত্তরাধিকারী হয়ে ক্ষমতায়
হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশার আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে ক্ষমতায় আনার জন্য সিরিয়ার সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে দেওয়া হয়। তার পিতা তিন দশক ধরে দেশ শাসন করলেও বাশার নতুন ধারার নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
২০০০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর: ‘দামেশক বসন্ত’
শাসনের শুরুতে এক সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সিরিয়ায় স্বাধীন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মানুষ তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায়। রাজনৈতিক সংস্কারের প্রত্যাশা দেখা দেয়। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আসাদ দ্রুত বিরোধীদের দমন নীতি গ্রহণ করে। বহু বিরোধী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়, আর সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ধূলিসাৎ হয়।
২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি: লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সিরিয়ার সরকারকে দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সিরিয়ার সেনাবাহিনী—যারা ১৯৭৬ সাল থেকে লেবাননে অবস্থান করছিল— লেবানন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এই ঘটনা সিরিয়ার আঞ্চলিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।
২০০৫ সালের ১৬ অক্টোবর: ‘দামেশক ঘোষণা’
সিরিয়ার বিরোধী দলগুলো ‘দামেশক ঘোষণা’ নামে একটি রাজনৈতিক বিবৃতি প্রকাশ করে। তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারের আহ্বান জানায়। সরকারের জবাব ছিল কঠোর। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালানো হয়। অনেককে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে বহু নেতাকে কারাবন্দী করা হয়।
২০১১ সালের ১৫ মার্চ: আরব বসন্তের ঢেউ এবং গণআন্দোলন দমন
আরব বসন্তের প্রভাব সিরিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হলে সরকার তা নির্মমভাবে দমন করে। এই দমনপীড়নের ফলে আন্দোলন র্যাডিকেল হয়ে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। এটি সিরিয়ার ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়।
২০১৩-২০১৫: ইরান ও রাশিয়ার সহায়তা
গৃহযুদ্ধের সময় বাশার আল-আসাদ ইরান ও রাশিয়ার সক্রিয় সহায়তা লাভ করেন। ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ তার পক্ষে অবস্থান নেয়। ২০১৫ সালে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সিরিয়ার সরকারকে কৌশলগত বিজয় অর্জনে সাহায্য করে। এই সময় বাশার আল আসাদের শাসন আরও সুসংহত হয়।
২০২১ সালের ২৬ মে: বিতর্কিত চতুর্থ মেয়াদ
বাশার আল-আসাদ চতুর্থবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সরকার ৯৫.১% ভোটে তার বিজয়ের দাবি করে। তবে বিরোধী দল এবং আন্তর্জাতিক মহল এই নির্বাচনকে অবৈধ ও প্রহসনমূলক বলে উল্লেখ করে। কুর্দি ও বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
২০২৩ সালের ১৯ মে: আরব কূটনীতিতে ফেরা
দীর্ঘ এক দশক পর বাশার আল আসাদ আরব লিগ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ২০১১ সালে গণআন্দোলন দমনের কারণে তিনি আরব বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। এই ফিরে আসা তার জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ
ফ্রান্সের আদালত বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এটি তার আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর: দামেশকের পতন, আসাদের পালিয়ে পলায়ন
স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আশ-শাম দামেশক দখল করে। বাশার আল-আসাদ মস্কোতে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ঘটনাটি তার শাসনের পতনের চূড়ান্ত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাশার আল-আসাদের শাসনের এই দশটি অধ্যায় সিরিয়ার ইতিহাসে গভীর প্রভাব রেখেছে। তার শাসন ছিল একদিকে দমনমূলক, অন্যদিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েনের ক্ষেত্র। সিরিয়ার জনগণ তার শাসনকালে গভীর ক্ষত ও বিভাজনের মুখোমুখি হয়, অগণিত নিরপরাধ মানুষের প্রাণনাশে সিরিয়ার আকাশ হয়ে উঠে রক্তাক্ত।
সূত্র: আল জাজিরা