ইসলামি ইতিহাস ও স্থাপত্যের এক অমূল্য রত্ন হলো দামেশকের উমাইয়া মসজিদ। এটি কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে অমর হয়ে আছে। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে নির্মিত এই মসজিদ ইতিহাসের নানা উত্থান-পতন ও আগুনের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার পরও আজও তার গৌরবময় ঐতিহ্য ও স্থাপত্যকলার নিদর্শন ধরে রেখেছে।
উমাইয়া মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস শুধুমাত্র দামেশক নগরীর সংস্কৃতিকে নতুন আঙ্গিকে পরিচিতি দেয়নি বরং এটি সমগ্র ইসলামি জগতের জন্য এক মাইলফলক হয়ে উঠেছে। এ মসজিদ একাধারে ইবাদতের স্থান, জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং শৈল্পিক উৎকর্ষের প্রতীক। নির্মাণশৈলী, ঐতিহাসিক সংযোগ এবং সংস্কারের দীর্ঘ ইতিহাসের সমন্বয়ে এটি ইসলামি স্থাপত্যকলার এক অনন্য উদাহরণ।

নির্মাণের ইতিহাস
উমাইয়া মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও সূচনা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। প্রথম মতে, সাহাবি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. দামেশক বিজয়ের পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে একটি খ্রিস্টান গির্জার পূর্বাংশ মসজিদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গির্জার পশ্চিম অংশ খ্রিস্টানদের ব্যবহারের জন্য রেখে দেওয়া হয়। তবে ৭০৬ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেই অংশ অধিগ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ গির্জা ভেঙে নতুনভাবে মসজিদ নির্মাণ করেন।
আরেক মতানুসারে উমাইয়া মসজিদ নির্মিত হয়েছিল একটি প্রাচীন রোমান মন্দিরের ভিত্তির ওপর, যা দেবতা জুপিটারের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। রোমান সম্রাট থিওডোর ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটিকে একটি খ্রিস্টান গির্জায় রূপান্তর করেন, যা পরিচিত ছিল সেন্ট জন গির্জা নামে। পরবর্তীতে সাহাবি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সেখানে মসজিদ স্থাপন করেন এবং খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক এটিকে মসজিদের পূর্ণরূপ দেন।
খলিফা ওয়ালিদ নির্মাণকাজে ফার্সি, হিন্দি এবং গ্রিক কারিগরদের অন্তর্ভুক্ত করেন। মসজিদ নির্মাণে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। তবে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দাবি করা হয়, এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে শূন্য থেকে নির্মাণ করা হয়েছিল পূর্ববর্তী মন্দির বা গির্জার কোন অস্তিত্বই ছিলো না।

মসজিদের স্থাপত্যশৈলী
উমাইয়া মসজিদ স্থাপত্যে ইসলামি নকশা এবং রোমান ও বাইজান্টাইন শিল্পের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এর নকশায় মসজিদে নববির স্থাপত্যের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। মসজিদের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে চতুর্দিক বারান্দাবিশিষ্ট একটি খোলা চত্বর। মূল মসজিদের ওপর একটি বিশাল গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মসজিদটির তিনটি মিনারও রয়েছে ।
মসজিদের গম্বুজ, দেয়াল এবং মেঝেতে মোজাইক অলংকরণ ইসলামি শৈল্পিক উৎকর্ষের অন্যতম নিদর্শন। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মাকবারা এবং পাশের হামিদিয়া বাজার এই মসজিদকে একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
ধ্বংস ও পুনর্নির্মাণ
উমাইয়া মসজিদ ইতিহাসে বহুবার ধ্বংস ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। মসজিদটি সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমি শাসনামলে বড় এক অগ্নিকান্ডের মাধ্যমে। এই অগ্নিকাণ্ডে মসজিদের মোজাইক এবং অলংকরণ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেলজুক শাসনামলে মসজিদের ছাদ, স্তম্ভ ও গম্বুজ সংস্কার করা হয়। পরবর্তীতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহিমাহুল্লাহ এবং মামলুক শাসকেরা এর পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লংয়ের আক্রমণের সময়। এতে মসজিদটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র বাইরের দেয়াল ছাড়া সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর দুই বছরের মধ্যেই এর পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মসজিদটি আবারও তার গৌরব ফিরে পায়।
আধুনিক সংস্কার
উমাইয়া মসজিদ ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যেমন ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তেমনি পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের মাধ্যমে তার গৌরবও ধরে রাখতে পেরেছে। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই স্থাপত্য তার অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও আধুনিক সংস্কারের ধারাবাহিকতায় আজও ইসলামি ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে বিদ্যমান।
১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের ছাদ মেরামতের সময় একটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই আগুনে মসজিদের গম্বুজ, নামাজের স্থান ও মার্বেল পাথরের অলংকরণ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এই ধ্বংসের মধ্যেও মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণ অর্থসহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। উসমানি সুলতান আব্দুল হামিদের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় পুনর্নির্মাণ কাজ—যা তিন বছর পর শুরু হয়ে নয় বছরে গিয়ে সম্পন্ন হয়।
এরপর ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের সর্বশেষ আধুনিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। এই সংস্কারের সময় মসজিদের বিভিন্ন মিনার, দেয়াল ও কাঠামো পুনর্নির্মাণ করা হয়। আঙিনার ভেতরে একটি নতুন গম্বুজও নির্মিত হয়। এই পুনর্নির্মাণে মসজিদটি আধুনিক স্থাপত্যকলার সঙ্গে মানানসই হয়ে ওঠে।
উমাইয়া মসজিদ একটি বিশাল আয়তাকার জমির ওপর নির্মিত, যার আকার ১৫৭x১০০ মিটার। এর মোট আয়তন প্রায় ১৫.৭ বর্গকিলোমিটার। মসজিদটি ঘিরে রয়েছে একটি প্রাচীন প্রাচীর, যা খোদাই করা পাথর দিয়ে তৈরি। ধারণা করা হয়, এই প্রাচীরটি প্রাচীন রোমান মন্দিরের সীমানা প্রাচীর ছিল।
মসজিদের কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি খোলা আঙিনা, যা চারপাশে খিলানযুক্ত বারান্দা দিয়ে ঘেরা। এই বারান্দাগুলো করিন্থীয় শৈলীর খুঁটির ওপর নির্মিত। আর দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে মসজিদের নামাজের স্থান।

উমাইয়া মসজিদের মিনার
মসজিদের স্থাপত্যের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর তিনটি মিনার। প্রতিটি মিনার ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক বিশেষ অধ্যায় ধারণ করে আছে।
মানারাতুল উরুস : উমাইয়া মসজিদের উত্তর দেয়ালের কেন্দ্রে অবস্থিত এই মিনারটি আলোকিত সৌন্দর্যের জন্য ‘মানারাতুল উরুস’ নামে পরিচিত। এটি কনের মতো উজ্জ্বল হওয়ায় এই নামকরণ করা হয়। মিনারটি ‘মানারাতুল বাইদা’ নামেও পরিচিত। কারণ, এটি সাদা রঙ করা হয়েছিল।
প্রথমে খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকের শাসনামলে নির্মিত এই মিনার একসময় স্বর্ণে রঞ্জিত ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে মিনারটির মূল ভিত্তি ছাড়া বাকি অংশ নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
মিনারাটি একটি বর্গাকার টাওয়ারের ওপর নির্মিত, যার চারপাশে খিলান আকৃতির জানালা রয়েছে। এর শীর্ষে কাঠের ছাউনি ও একটি খোলা বারান্দা আছে। ভেতরে সর্পিল সিঁড়ি শীর্ষে নিয়ে যায়। একসময় এই মিনারটি নামাজের সময় ইমামের তাকবির পুনরাবৃত্তির জন্য ব্যবহৃত হতো।
মানারাত ঈসা : মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই মিনারটি উমাইয়া মসজিদের সর্বোচ্চ মিনার। এর উচ্চতা ৭৭ মিটার। এই মিনারটি দুই অংশে বিভক্ত—নিচের অংশটি বর্গাকার এবং উপরের অংশটি অষ্টভুজাকৃতির।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বানী অনুসারে, নবি ঈসা আলাইহিস সালাম কেয়ামতের পূর্বে এই মিনারে অবতরণ করবেন। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মিনারটিতে দুটি বারান্দা রয়েছে, তবে সেগুলো ছাউনিবিহীন। মিনারের শীর্ষে একটি শঙ্কু আকৃতির গম্বুজ রয়েছে, যা অলংকৃত বল এবং পূর্ণ চাঁদের প্রতীক ধারণ করে।
মানারাত কাইতবাই : মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত এই মিনারটি প্রথম নির্মিত হয় খলিফা ওয়ালিদের শাসনামলে। তবে ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লংয়ের আক্রমণে মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের সময় এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
পরবর্তীতে মিশরের সুলতান কাইতবাই এটিকে পুনর্নির্মাণ করেন এবং তার নামানুসারে মিনারটির নামকরণ করা হয়। এটি মিশরীয় স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন।
উমাইয়া মসজিদের স্থাপত্যশৈলী, আধুনিক সংস্কার ও তিনটি মিনারের আলাদা পরিচিতি এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যকলার শৈল্পিক গভীরতাকে স্পষ্ট করে। ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারায় মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উমাইয়া মসজিদের দরজা
ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক এই মসজিদের প্রতিটি কোণায় রয়েছে সুক্ষ্ম কারুকাজ এবং ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
উমাইয়া মসজিদের প্রধান দরজা : উমাইয়া মসজিদে চারটি প্রধান দরজা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দরজা মসজিদের খোলা আঙিনায় প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হয়, আরেকটি দরজা সরাসরি মসজিদে নিয়ে যায়। প্রতিটি দরজা স্থাপত্যের শৈল্পিক সুষমা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
বাব শারকি বা পূর্ব দরজা : মসজিদের পূর্বদিকের এই দরজাটি সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ। এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। কাইমারিয়া মহল্লার পাশে অবস্থিত হওয়ায় এটি ‘বাবুল কাইমারিয়া’ নামে পরিচিত। মামলুক আমলে এর নাম ছিল ‘বাবুল লাব্বাদিন’, যা মসজিদের কাছাকাছি লাব্বাদিন বাজারের কারণে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও এটিকে ‘বাবুস সাআত’ এবং ‘বাবুন নাওফারা’ বলা হয়। কারণ, এটি নাওফারা মহল্লার দিকে মুখ করে।
বাব শারকি একটি বড় প্রবেশপথসহ দুই পাশের ছোট দরজা নিয়ে গঠিত। দরজার সামনে একটি পুরোনো সিঁড়ি রয়েছে, যা ব্যবহার করে ওপরে ওঠতে হয়। ঐতিহাসিকভাবে দরজাটি পাইনের কাঠ দিয়ে তৈরি এবং তামার পাত দিয়ে মোড়ানো ছিল। ১২৫০ সালে এক অগ্নিকাণ্ডে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মামলুক আমলে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
দরজার ছোট অংশগুলো ছয়টি চৌকো ঘরে বিভক্ত, যেগুলো ফুলের নকশায় সজ্জিত। ডান দিকের দরজায় মামলুক সুলতান আল মুআইয়েদের নাম অঙ্কিত শিলালিপি দেখা যায়। বাম পাশের দরজায় রয়েছে শেখ আল খাসকির প্রতীক। তবে মূল বড় দরজাটি সাদামাটা, এতে কোন নকশা নেই।
বাব শিমালি বা উত্তর দরজা : উমাইয়া মসজিদের উত্তর দেয়ালের কেন্দ্রে অবস্থিত এই দরজাটি মানারাতুল উরুসের ঠিক নিচে অবস্থিত। ‘বাবুল ক্লাসা’ নামে পরিচিত এই দরজাটি ক্লাসা মহল্লার দিকে মুখ করে আছে। এর আরও দুটি নাম রয়েছে— ‘বাবুল ইমারাহ’ এবং ‘বাবুল ফারাদাইস’।
বাবুল ক্লাসা কাঠ দিয়ে তৈরি এবং ধাতুর পাত দিয়ে মোড়ানো। এর ওপর মামলুক সুলতান নাসির ফারাজ ইবনে বারকুকের প্রতীক রয়েছে। এতে বুঝা যায়, দরজাটি তাঁর শাসনামলে নির্মিত।
দক্ষিণ দরজা বা বাবুল কিবলা : মসজিদের দক্ষিণ দেয়ালের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই দরজাটি সরাসরি মসজিদে প্রবেশের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ‘বাবুজ জিয়াদা’ নামে পরিচিত ছিল। কারণ, মসজিদ নির্মাণের সময় দরজার আশপাশের প্রাচীর সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এটি ‘বাবুস সাগাহ’ নামে পরিচিত। স্বর্ণের মার্কেটের পাশে হওয়ার কারণে এ নাম দেওয়া হয়েছে।

মূল মসজিদ
মূল মসজিদ একটি আয়তাকার জায়গার উপর অবস্থিত, যার দৈর্ঘ্য ১৩৬ মিটার এবং প্রস্থ ৩৭ মিটার। এটি তিনটি লম্বা অঙ্গনের সমন্বয়ে গঠিত, যা দুই সারি স্তম্ভ দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। স্তম্ভগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। চতুর্থ অঙ্গনটি এই তিনটি অঙ্গনের সাথে লম্ভাভাবে যুক্ত এবং এটিকে ‘মিজাজ’ বলা হয়।
মিজাজের স্থান বেশি প্রশস্ত এবং এটি মসজিদের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত বিস্তৃত। মিজাজের মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ রয়েছে, যা ৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। গম্বুজটি ৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং এটি ‘কুব্বাতুন নাসর’ বা ‘ঈগল গম্বুজ’ নামে পরিচিত।
মূল মসজিদের চারপাশে রয়েছে ২২টি জানালা। এগুলো উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের পাশাপাশি মিজাজের অংশেও অবস্থিত। গম্বুজের ভেতরের জানালাগুলো রঙিন কাঁচ দিয়ে সজ্জিত, যা অভ্যন্তরে মৃদু আলো আবহ সৃষ্টি করে। এটি মূল মসজিদে এক অনন্য নান্দনিকতা সৃষ্টি করে।

মসজিদের আঙিনা
উমাইয়া মসজিদের চারটি প্রধান আঙিনা রয়েছে, যেগুলোকে ‘মাশাহেদ’ বলা হয়। প্রতিটি আঙিনার নামকরণ ইসলামের চার খলিফার নামে করা হয়েছে।
১. মাশহাদ আবু বকর আস সিদ্দিক রা. : দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এখানে ১৯৮৯ সালে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
২. মাশহাদ উমর ইবনুল খাত্তাব রা. : দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এটি বর্তমানে মসজিদের প্রশাসনিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩. মাশহাদ উসমান ইবনু আফফান: উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এটি অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য ব্যবহৃত হয়।
৪. মাশহাদ আলি ইবনে আবু তালিব: উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এটি পরবর্তীতে ‘মাশহাদ জাইনুল আবিদিন’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
পূর্ব দিকে আরও একটি সংযুক্ত মাশহাদ রয়েছে, যা ‘মাশহাদ আল হুসাইন’ নামে পরিচিত। এখানে ইমাম হুসাইনের মাজার রয়েছে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। উমাইয়া মসজিদের এই দরজা ও অভ্যন্তরীণ স্থাপনার বৈচিত্র্য ইসলামি স্থাপত্যকলার সৃজনশীলতা ও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
উমাইয়া মসজিদের বারান্দা
উমাইয়া মসজিদের সাহান বা খোলা আঙিনা একটি বিস্তৃত আয়তাকার চত্বর। যার দৈর্ঘ্য ১৩২ মিটার এবং প্রস্থ ৫০ মিটার। এই চত্বরকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ১০ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর দিকের বারান্দাগুলো আঙিনার মূল অংশ থেকে সামান্য উঁচুতে স্থাপিত, যা মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে এক অনন্যতা যোগ করেছে।
বারান্দাগুলোতে রয়েছে এক সারি খিলান, যা শক্তিশালী পাথরের স্তম্ভ ও পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি স্তম্ভ এক পাথরখণ্ড থেকে তৈরি এবং করিন্থিয়ান শৈলীর সুদৃশ্য মুকুট দিয়ে অলঙ্কৃত। স্তম্ভের পাশাপাশি খিলানগুলোও মার্বেল পাথরে মোড়ানো। বারান্দার কাঠের ছাদ সিসার পাত দিয়ে আবৃত, যা এটির রূপে নান্দনিকতা এনেছে। তবে ১৭৫৯ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মসজিদের উত্তর দিকের বারান্দা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে পুনর্নির্মাণের পর এটি আগের শৈলীর কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ফিরে আসে।
আঙিনার গম্বুজসমূহ
আঙ্গিনায় অবস্থিত তিনটি ছোট গম্বুজ মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এগুলো কেবল নান্দনিক নয়, বরং ঐতিহাসিক গুরুত্বও বহন করে।
খাজনার গম্বুজ : আঙিনার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই গম্বুজটি অষ্টভুজাকার কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। আটটি করিন্থিয়ান শৈলীর স্তম্ভ দিয়ে ঘেরা গম্বুজটি খলিফা আল মাহদির শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। এটি একসময় মসজিদের অর্থাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে একে ‘খাজনার গম্বুজ’ বলা হয়।
ঘড়ির গম্বুজ : আঙ্গিনার পূর্ব দিকে অবস্থিত এই গম্বুজটি ‘কুব্বাত জাইনুল আবিদিন’ নামেও পরিচিত। এটি মসজিদের সময় নির্ণয়ক ব্যবহৃত হতো।
উসমানি গম্বুজ : আঙিনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই গম্বুজটি মূলত অজুখানা হিসেবে ব্যবহৃত বর্গাকার একটি পুকুরের ওপর নির্মিত। পুকুরের চারপাশে স্তম্ভের ওপর একটি ছাদ এবং তার ওপর স্থাপিত ছোট এই গম্বুজ আঙিনাকে এক অনন্য সৌন্দর্যে পূর্ণ করেছে।

মসজিদের অলংকার
উমাইয়া মসজিদের অলংকরণ ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের এক অতুলনীয় নিদর্শন। মসজিদের দেয়ালজুড়ে কাচের মোজাইক, মার্বেল এবং বিভিন্ন ধাতব নকশায় গড়ে তোলা কারুকাজ স্থাপনাটিকে এক অসাধারণ শিল্পকর্মে রূপ দিয়েছে। বাইজেন্টাইন আমলের কারুশিল্প ও উমাইয়া স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধনে নির্মিত এই মসজিদ ইসলামের প্রথম যুগের শিল্পকলার পরিচয় বহন করে।
বিশেষ করে মসজিদের প্রধান প্রবেশপথে অবস্থিত ‘নাহর বারদা’ মোজাইক চিত্রের এক আকর্ষণীয় সৃষ্টি। এতে নদীর ধারে অবস্থিত বাড়িঘর, খিলান এবং গাছপালার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এটি উমাইয়া যুগের প্রকৃতিপ্রেম ও শিল্পকলা সম্পর্কে এক অসাধারণ ধারণা পাওয়া যায়।

স্তম্ভ, খিলান এবং ক্যালিগ্রাফি
মসজিদের স্তম্ভ ও খিলানে করিন্থিয়ান মুকুটের ব্যবহার বাইজেন্টাইন এবং ইসলামী শিল্পকলার মিশ্রণকে তুলে ধরে। মার্বেলের খোদাই, কাশানির কারুকাজ এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি মসজিদের অলংকরণকে এক অনন্যতা দিয়েছে। দেয়াল ও গম্বুজজুড়ে কুরআন কারিমের আয়াত খোদাই করা রয়েছে। রঙিন কাচের জানালা থেকে প্রবেশ করা সূর্যালোক অভ্যন্তরকে মৃদু আলোয় আলোকিত করে, যা এক নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মসজিদে শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা
উমাইয়া মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থান নয়, বরং এটি একসময় জ্ঞানচর্চার একটি বিশাল কেন্দ্র ছিল। মসজিদের বিভিন্ন অংশে শিক্ষার আসর বসত। সেখানে শায়েখগণ ফিকহ, হাদিস এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদান করতেন। মসজিদের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছিল একাধিক মাদরাসা, যেখানে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের আনাগোনা ছিল।
উল্লেখযোগ্য কিছু মাদরাসা
মাদরাসা আল-গাজালিয়া : ইমাম গাজালির নামে প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসাটি শাফেয়ি মাজহাবের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
মাদরাসা আল মানজাইয়া: হানাফি মাজহাবের জন্য বিশেষায়িত এই শিক্ষাকেন্দ্রটি ইবনে মানজা এর নামে প্রতিষ্ঠিত।
জাবিয়া মালিকি : তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষর্থীদের জন্য উন্মুক্ত এই মাদরাসায় মরক্কোসহ পশ্চিম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল।
দারুল হাদিস আল ফাদিলিয়া: এটি বিচারপতি আব্দুর রহিম আল আসকালানির নামে প্রতিষ্ঠিত এবং হাদিস শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
মসজিদের গ্রন্থাগার
মসজিদের অভ্যন্তরে একটি অসাধারণ গ্রন্থাগার আছে। যেখানে সংরক্ষিত আছে অমূল্য পাণ্ডুলিপি ও পবিত্র কুরআনের নুসখা। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, উসমান ইবনে আফফান রাজিআল্লাহু আনহুর হাতে লেখা পবিত্র কুরআনের একটি কপি।
তথ্যসূত্র :
১. আল জাজিরা
২. বিভিন্ন ওয়েবসাইট