ইসলাম ইনসাইট

আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতনের ধারাবাহিক ইতিহাস (৩য় ও শেষ পর্ব)

 

মায়ানমার (বার্মা) স্বাধীনতা লাভের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৭ জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়। এতে সন্ত্রাসী মগরা নড়েচড়ে বসে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন বার্মার প্রধানমন্ত্রী, ইতিহাসের জঘন্যতম খুনি নে উইন সংসদে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার সব বাতিল করে দেয়!! সংখ্যালঘুদের অধিকার! অর্থাৎ এখানে এই খুনি সংখ্যালঘুদের সব অধিকার বাতিলের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সকল অধিকার বাতিল করে দেয় !!

 

১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সকল অর্গানাইজেশন নিষিদ্ধ করে দেয় বার্মা সরকার। তার পরের বছর ই নিউজ চ্যানেলগুলোতে রোহিঙ্গা ভাষায় নিউজ করা বন্ধ করে দেয়। ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিলের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে তাদের সবধরনের নাগরিক সুবিধা বাতিল করে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন করে দেয় খুনি নে উইনের সরকার!

এই খুনি নে উইন তার সময়ে আরাকানে ১৪ টি সামরিক অভিযান চালায় , এতে অনেক রোহিঙ্গা গণহত্যার শিকার হয়। সকল নাগরিক রাষ্ট্রীয় সুবিধা বাতিলের পর পরই সরকারী বাহিনীতে কর্মরত সকল রোহিঙ্গাদেরকে অন্যায়ভাবে চাকরীচ্যুত করা হয়।

 

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘নাগা মিন (কিং ড্রাগন) অপারেশন’ অভিযান পরিচালিত হয় কুখ্যাত জেনারেল নে-উইন-এর নেতৃত্বে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত আন্দোলন দমন করা। এই সময় আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে নির্বিচারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে শহীদ করা হয়। সে সময় নাগামিন ড্রাগন অপারেশনের ফলে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

 

এই হত্যাকাণ্ডের সময় রোহিঙ্গাদের সকল এনআইডি কার্ড কেড়ে নেয় মায়ানমার সরকার যাতে তাদেরকে বাঙালী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে।

নতুন আইনে “রোহিঙ্গারা আরাকানের নাগরিক নয়” উল্লেখ করা হয়। এভাবে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের আইনিভাবে না-মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

 

১৯৯১ থেকে ৯২ সালে এক বছরের মধ্যে সন্ত্রাসী বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১৯ টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে  ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। নতুন করে শুরু হওয়া এই গণহত্যায় হাজারো রোহিঙ্গা মুসলিম শহীদ হন। চারলাখেরও অধিক রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে আবারো চট্রগ্রামে আশ্রয় নেন।

 

বিশবছর পর ২০১২ সালের ৩ জুন আবারো শুরু হয় গণহত্যা। তাবলীগের দশজন সাথীকে শহীদ করার মধ্য দিয়ে গণহত্যা শুরু করে মগ সন্ত্রাসীরা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত থেমে থেমে এই গণহত্যা চলতে থাকে।

২০১৭ সালে খারেজী সংগঠন  আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) দের কিছু উগ্র কার্যক্রমের কারণে মায়ানমার জান্তা সরকার ও সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি(মগ জলদস্যুদের উত্তরসূরী) ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। ঐসময়ে রোহিঙ্গাদের উপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা আঁকতে থাকতে জান্তা সরকার এবং তাদের পক্ষপাতদুষ্ট মগসন্ত্রাসীরা যাদেরকে আমরা বর্তমানে আরাকান আর্মি হিসেবে চিনি। এই লক্ষ্যে জান্তা সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী চাইছিল যেকোনো একটা রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে ফাঁদে ফেলতে এবং খারেজী সংগঠন আরসাকে তারা সেই ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়। ফাঁদে পড়ে আরসা নামকাওয়াস্তে কয়েকটা জায়গায় হামলা চালায়। এতেত তাদের নিজেদেরই ৭০-৭২ জন সৈন্য নিহত হয়, কিন্তু মাত্র কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে তারা হত্যা করে। এই ছুতোয় বর্তমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালিয়ে দেয় জান্তা সরকার ও তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি। সেসময় গণহত্যার হাজারো বিভৎস দৃশ্য ফেসবুক, ইউটিউবসহ সোশ্যাল মিডিয়াতে তোলপাড় করে। সারাবিশ্বের মুসলমানরা তখন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। দশলাখেরও অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম কক্সবাজারে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।

 

২০২৪ সালের মে মাস থেকে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি আরাকানে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে গণহত্যা চালানো শুরু করে। তারা এতটা ভয়াবহ আকারে গণহত্যা চালাচ্ছে যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে Rohingya Genocide 2.0 বলে ঘোষণা দিয়েছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে রোহিঙ্গা মুসলিমরাই একমাত্র জাতি যারা কিনা বারবার গণহত্যার শিকার হয়েছে। এখনো গণহত্যার মুখোমুখি তাদের হতে হচ্ছে। অথচ প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের উচিত ছিল জিহাদের ফরজ দায়িত্ব পালন করে আরাকানকে মুক্ত করা। এটা যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে আরাকানের মজলুম মুসলমানরা মুক্ত হতে পারবে না। তারা আবারো সেই গণহত্যার সম্মুখীন হতেই থাকবে। তাই আমাদের উচিত সেই দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করা, যেভাবে করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী সাঃ এবং তার সাহাবীরা।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore