ভারতের গত নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল বিজিপিতে এই ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ৩০০ মিলিয়ন ডলার খুনি শেখ হাসিনার মদদে বিজেপিকে দেয় এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্ৰ আন্দোলনের সময় জুলাই ২৮ ও ২৯ তারিখে পুলিশ যখন আন্দোলন দমানোর নামে নির্বিচারে ছাত্রদের উপর গুলি করেছিল তখন এই ওবায়দুল করিম শেখ হাসিনাকে খুশি রাখতে আমলা, পুলিশের উচ্চমহল ও ছাত্ৰলীগ ক্যাডারদের অস্র, টাকা-পয়সা সহ সার্বিক দিক দিয়ে সাহায্য করে।
এছাড়া ৪-৫ তারিখের ছাত্ৰ গণহত্যারও তার বড় ভূমিকা ছিল। সে তখন বিভিন্ন উচ্চ মহলকে উদ্বুদ্ধ করে তারা যাতে খুনি হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ছাত্ৰদের উপর গণহত্যা চালাতে পিছপা না হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শামীম উসমানের অস্র হাতে তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে নারায়ণগঞ্জে গণহত্যা চালায় সেটির পিছনেও অন্যতম ইন্ধনদাতা ছিল এই ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম।
এটি তো গেল সমসাময়িক ঘটনা। কিন্তু এছাড়াও ওবায়দুল করিমের কুকীর্তিনামার সংখ্যা পাহাড় পরিমাণ। নিচে এর মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হলো :
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দুর্নীতি
ওয়াছিউর রহমান খসরু, ঢাকা : গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়ন গ্রুপ তাদের বিনিয়োগে দেখিয়েছিল ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু এরমধ্যে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবে দেখানো হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার বাকি অর্থ বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে। যেসব খরচের প্রায় পুরোটাই বায়বীয়। বাস্তবে এসব খরচ হয়েছে কিনা এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে এবং এসব খরচের যৌক্তিক প্রমাণও ওরিয়ন কাগজপত্রে তুলে ধরেনি। যে কারণে সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, ওরিয়নের দৃশ্যমান বিনিয়োগ মাত্র দেড় লাখ টাকা। এই দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা মূল্যের প্রকল্পের মালিক হয়ে গেছে নির্মাতা ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপ।
২০০৩ সালের গোড়ার দিকে বেসরকারি বিনিয়োগে (বিওওটি) পদ্ধতিতে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করলে ডজন খানেক দরপত্রের মধ্য হতে কারিগরি দিক বিবেচনা ও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বেলহাসা-একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটকে কাজ দেওয়া হয়। তাদের দরপত্রে উল্লেখ ছিল ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে নেদারল্যান্ডের আইএনজি ব্যাংক ৮ কোটি ডলার, বেলহাসা সাড়ে ৭ কোটি দিরহাম এবং বাংলাদেশের একম ইঞ্জিনিয়ারিং ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জালিয়াতির মাধ্যমে কার্যাদেশ দেয়া হয় ৬৬০ কোটি টাকা।
বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটি বাতিল করলে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২২ জুন প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। এ সময় নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষে এর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়েছে। তাই নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু, দৈর্ঘ্য বাড়ানোর নকশা কে অনুমোদন করেছে। ব্যয় বৃদ্ধিই বা কে অনুমোদন করেছে এসবের কোন তথ্য নেই।
লোন
ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম তার কোম্পানির আন্ডারে থাকা বিভিন্ন সাব কোম্পানির নামে( বিশেষ করে ওরিয়ন অয়েল এন্ড শিপিং লিমিটেড, ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন পাওয়ার, ওরিয়ন গ্যাস ইত্যাদি) ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক থেকে টোটাল লোন নিয়েছেন ১১,৪১৯ (এগারো হাজার চারশো উনিশ ) কোটি টাকা যার মধ্যে ৯০% এর মতো তিনি আজও পরিশোধ করেননি।
বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি
দীর্ঘ ১৪ (২০০৯-২০২৩) বছরে ক্যাপাসিটি চার্জে শীর্ষ দশ লুটেরা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যারা কিনা একাই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুট করেছে ৪,৫২৫ কোটি টাকা।
শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি
ওরিয়ন গ্রুপের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিটি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের অন্যতম বড় কেলেঙ্কারির মধ্যে একটি। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের সময় ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান, ওবায়দুল করিম, এই কেলেঙ্কারির মূল হোতা হিসেবে উঠে আসেন। এই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে তিনি শেয়ার বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
লুটের পরিমাণ
ওরিয়ন গ্রুপের কেলেঙ্কারিতে মোট অর্থের পরিমাণ আনুমানিক ৬০০ কোটি টাকা, যা তিনি শেয়ার হোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করে তুলে নেন। বিভিন্ন ভুয়া রিপোর্ট এবং বাজারের পরিস্থিতি প্রভাবিত করে তিনি এই অর্থ হাতিয়ে নেন। ওরিয়ন ফিউশনের ৩৫৯ কোটি টাকার লোন আছে যার ৯০ কোটি এখনও পরিশোধ করা হয়নি তা সত্ত্বেও ২০২৪ সালে ওরিয়ন ফিউশন তাদের স্টকের মূল্য পূর্বের চেয়ে গায়েবি ভাবে দ্বিগুণ দেখিয়েছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে ওবায়দুল করিমের ব্যবসা
তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা, এমপি এবং মন্ত্রীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। এই নেতাদের মধ্যে অনেকেই তার বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তাকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করেছেন। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্প এবং চুক্তি পেতে তিনি এই সম্পর্কগুলো কাজে লাগিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : ওবায়দুল করিম, মির্জা আজম সাবেক এমপি জামালপুর-৩ (সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী), আল্লাউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ফেনী-১ (সাবেক সংসদ সদস্য), শামীম ওসমান সাবেক সংসদ সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৪ যাদের সঙ্গে মিলে উনি Oríon Pharma Limited, Lakdhanavi Limited, Digital PowerGeneration Limited, ১০২ মেগাওয়াটের HFO POWER PLANT নামের বিভিন্ন কোম্পানি গড়ে তুলেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্প ও বিতর্ক
ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের নাম পদ্মা সেতুর মেগা প্রকল্পেও উঠে আসে। যদিও সরাসরি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বড় প্রকল্পগুলোতে তার সম্পৃক্ততা এবং এর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।
মানি লন্ডারিং
২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের সময় ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে শেয়ারহোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লুটপাট করেন। এর পর তিনি এই বিপুল অর্থের একটি বড় অংশ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করেন।
এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় বিদেশে বিনিয়োগের নামে অর্থ পাচার করেছেন এবং ব্যবসা সম্প্রসারণের আড়ালে এসব টাকা বৈধ করার চেষ্টা করেছেন। আন্তর্জাতিক ব্যাংক এবং অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে তিনি এই অর্থ বিদেশে পাঠিয়েছেন।
মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম প্রায় ২০০ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে দুবাইয়ে পাঠিয়েছেন এবং আল জাদ্দাফ এলাকায় ৫৫,০০০ বর্গফুট বিশিষ্ট ১৩ তলা বিল্ডিং “রিফ্লেকশন হোটেল” ক্রয় করেছেন। এছাড়াও, তিনি দুবাইয়ে “ফার্স্টজেন এনার্জি FZE” এবং “এনার্জন টেকনোলজিস FZE” নামে বিভিন্ন কোম্পানি নিবন্ধন করেছেন। এই বিদেশি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে তিনি ১৩০৬ কোটি টাকা “এনার্জন রিনিউএবলস লিমিটেড”-এর নামে এবং ১০৭৬ কোটি টাকা “ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেড”-এর নামে উত্তোলন করেন। তবে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়নি এবং বরং এই অর্থগুলোও দুবাইয়ে পাচার করেন। তার ড্রাইভার খালেদ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বর্তমানে তার ব্যবসায়িক অংশীদার।
ওরিয়েন্টাল ব্যাংক লুটপাট
মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাথে জোট বেঁধে অসাধু উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করেন। করিম এবং তার সহযোগীরা ব্যাংক থেকে ৫৯৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়ায় তারা ভুয়া ঋণ দেখিয়ে এবং ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করে অর্থ হাতিয়ে নেন।
+ লুটপাটের কৌশল
ওবায়দুল করিম ও তার সহযোগীরা ভুয়া কোম্পানি ও প্রকল্পের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। এছাড়া ব্যাংকের ভেতরে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই লুটপাটটি চালানো হয়। এই দুর্নীতি ধরা পড়ার পর, বাংলাদেশ ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে এবং ব্যাংকটিকে পুনর্গঠনের জন্য ব্যবস্থা নেয়।
এ ঘটনায় মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় এবং তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে তিনি আইনের ফাঁকফোকরে এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে মুক্তি লাভ করেন।
বিশাল অঙ্কের ঋণখেলাপি হয়েও বিলাসী জীবনযাপন
মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও অর্থব্যয়ের ঘটনা ডাকে বুঝার উপায় নেই তিনি যে এত বড় ঋণে ডুবে আছেন। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক লুটপাটসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যে বিপুল অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেছেন, তা মূলত তার এই ব্যয়বহুল জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে, তার ছেলে সালমান করিমের বিয়ে ছিল করিম পরিবারের বিলাসী জীবনযাত্রার অন্যতম উদাহরণ।
+ সালমান করিমের বিলাসবহুল বিয়ে
সালমান করিমের বিয়ের অনুষ্ঠানটি দুবাইয়ের অত্যন্ত অভিজাত জায়গাগুলোতে আয়োজন করা হয়। বিয়ের আয়োজন হয় দুবাইয়ের ম্যান্ডারিন ওরিয়েন্টাল জুমেইরাহ এবং বুর্জ আল আরব (৭-তারকা হোটেল)-এ, যা বিশ্ববিখ্যাত অভিজাত স্থান গুলোর একটি। এই বিবাহ অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ছিল এবং ধারণা করা হয়, বিয়ের পুরো আয়োজনে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়।
তবে এই বিপুল অর্থ বৈধ উপায়ে ব্যয় হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হয়, বিয়ের এই ব্যয়ের অর্থ বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করে দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অবৈধ উৎস এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এসব অর্থ করিম পরিবার দুবাইয়ে স্থানান্তর করে এবং বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পেছনে ব্যয় করে।
মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের এই বিলাসী জীবনযাত্রা এবং অবৈধ অর্থব্যয় নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা থাকলেও, এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।