২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি পায়। আওয়ামী লীগের পতন শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল না; এটি ছিল দীর্ঘ ১৬ বছরের এমন এক শাসনের অবসান যেখানে ইসলাম, মুসলিম ও ইসলামপন্থী মানুষকে দমনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত এটি ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী প্রভাব থেকে মুক্তি যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো বদলে দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে—এই মুক্তির মূল উদ্দেশ্য অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। সরাসরি মূল শত্রুর বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে কিছু মানুষ জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসকে প্রধান লক্ষ্য বানিয়েছেন। চলুন আমরা যাচাই করে দেখি বাস্তবতা কি?
জাতিসংঘের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘ নিয়ে সমালোচনার অভাব নেই—আমরা কোনোভাবেই একে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির প্রভাবমুক্ত বলতে পারি না। সেইসাথে অনেক ক্ষেত্রে এটি দ্বৈত মানদণ্ডে কাজ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিবাচক কিছু ভূমিকাও তারা রেখেছে। যেমনঃ
(ক) গাজা: সেখানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ইসরাইল পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। যদিও আমেরিকান ও জায়োনিস্ট লবির প্রভাবে যুদ্ধ বন্ধে কোনো বাস্তব অগ্রগতি আনতে পারেনি।
(খ) রোহিঙ্গা: রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করেছে।
(গ) বাংলাদেশে গুম-খুন: শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ছত্রছায়ায় চালানো গুম ও খুনের ঘটনায় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে।
(ঘ) জুলাই বিপ্লব: শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনাও আনুষ্ঠানিকভাবে নথিবদ্ধ করেছে।
জাতিসংঘ সম্পর্কে একটি প্রচলিত অভিযোগ হলো—এটি নাকি বাংলাদেশে LGBTQ আইন চাপিয়ে দেবে। বাস্তবে কোনো দেশের ওপর আইন চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। তারা সুপারিশ করতে পারে, রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে বা প্রকল্পে অর্থায়ন করতে পারে; কিন্তু আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের হাতে থাকে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ জনগণ সমকামীতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন, সেখানে এমন আইন পাশ করানো কার্যত অসম্ভব। এবিষয়টি জাতিসংঘ ভালো করেই জানে।
তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তা ভারতের হাতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে যাওয়ার চেয়ে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভারত আবার প্রভাব বিস্তার করলে ইসলাম, মুসলিম ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দমননীতি দ্রুত ফিরে আসবে। বিগত ১৫ বছরের অতীত যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
যাচাই করে দেখুন: আপনি কি শত্রুর ধোঁকার শিকার?
৫ আগস্টের পর জাতিসংঘের উপস্থিতি হিন্দুত্ববাদী ভারতের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে, কারণ এটি অতীতের অনেক গোপন বিষয় প্রকাশ করে দিবে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদেরকে আরো কোণঠাসা করে দিবে; বিশেষ করে তার নোংরা ইসলাম বিদ্বেষ আরো খোলামেলা আলোচনায় আসবে। এতে করে ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্যে আওয়ামীলীগের সময়ের কর্মকান্ড প্রকাশিত হয়ে তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসার দরজা চিরতরে বন্ধ হবে।
তাই যারা খুনি হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে তারাই সূক্ষ্মভাবে অতিমাত্রায় সরল কিছু ইসলামপন্থী মানুষকে খুঁজে নিয়েছে। তাদের মাধ্যমে মূল শত্রুকে ভুলে পূর্ণাঙ্গ ফোকাস সরিয়ে জাতিসংঘের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘শত্রুর দিকভ্রান্তি কৌশল’ (Enemy Diversion Program) যার উদ্দেশ্য হলো, আপনার মনোযোগ ও প্রতিরোধ শক্তিকে আসল লক্ষ্য (হিন্দুত্ববাদীদের) থেকে সরিয়ে এমন জায়গায় কেন্দ্রীভূত করা, যা শত্রুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।
এই কৌশল সাধারণত যেভাবে কাজ করে
(ক) আবেগী বিষয় খুঁজে বের করা – ইসলামপন্থী তরুণদের মধ্যে যেটি সহজে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে (যেমন—জাতিসংঘের কিছু বিতর্কিত প্রস্তাব বা পশ্চিমা এজেন্ডা)।
(খ) ভেতরের লোক ব্যবহার করা – কিছু ক্ষেত্রে সৎ কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অদক্ষ বা অজ্ঞ কিছু মানুষকে এই ইস্যুর মুখপাত্র বানিয়ে দেওয়া যেন তারা জনতার সামনে সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হয় ও তরুণদের উসকে বেড়ায়।
(গ) মূল শত্রুকে আড়াল করা – যত বেশি মানুষ ভুল টার্গেটে মনোযোগ দেবে তত কম মানুষ আসল শত্রুর (ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী প্রভাব) বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
(ঘ) প্রমাণ তৈরি করে শত্রুর স্বার্থে ব্যবহার – আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেখানো , “বাংলাদেশের মুসলিমরা পশ্চিমা সংস্থা ও জাতিসংঘের জন্য হুমকি”। এতে ভারত আবার বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা দায়িত্ব’ নেওয়ার অজুহাত পাবে।
(ঙ) দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা – ভুল পথে শক্তি ক্ষয় করার ফলে আসল শত্রু নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। যেমনঃ রাজনৈতিক মিত্র তৈরি, নিরাপত্তা চুক্তি ও গোয়েন্দা উপস্থিতি পুনঃস্থাপন।
ফলে যারা আন্তরিকভাবে ‘সঠিক কাজ’ করার চেষ্টা করছে, তারাই না বুঝে এমন কাজ করছে যা আসলে শত্রুর পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। এটি অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রের অংশ যেখানে শত্রু আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার না করেই আপনাকে তার পক্ষে ব্যবহার করে ফেলে ।
বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ, আলেম সমাজ, তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণী—সবার জন্য জরুরি হলো বাস্তবতা বোঝা। জাতিসংঘের সমালোচনা যেখানে প্রয়োজন সেখানে করতে হবে; কিন্তু মূল শত্রুকে আড়াল করে এমন কোনো অবস্থান নেওয়া উচিত নয় যা সরাসরি তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সীমাবদ্ধতা ও একটি আঞ্চলিক শক্তির শত্রুতার মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিরোধিতা করা সম্ভব; কিন্তু দ্বিতীয়টি একবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে, তা ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ আক্রমণে পরিণত হবে।
সেইসাথে এটাও বুঝতে হবে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন বিষয়। মুক্তির পরের লড়াই সবসময় জটিল—কারণ এটি শুরু হয় মানুষের মানসিকতা ও সচেতনতার মাধ্যমে । আমাদের আজকের চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি কৌশলগত বাস্তবতা বুঝা। আমরা যদি প্রকৃত শত্রুকে ভুলে যাই, তবে তারা কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিবে।