ইসলাম ইনসাইট

২৫ শে আগস্ট রোহিঙ্গা গণহত্যায় খারেজী আরসার ভূমিকা

২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়ার মাত্র ছয় ঘণ্টা পরই, রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বার্থ বিরোধী ও পথভ্রষ্ট খারেজী সম্প্রদায়ের আকিদা পোষণকারী সংগঠন “আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশান আর্মি/হারাকাতুল ইয়াক্বীন তথা আরসা” আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের ২৪টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং ৫৫২ নং লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ৭টি ক্যাম্পে অপরিকল্পিত ও দুর্বল ধাঁচের একটি হামলা করে বসে। আর এতে করে মুহূর্তেই ভেস্তে যায় কফি আনান কমিশনের সকল সুপারিশনামা এবং একই সাথে এই অপরিকল্পিত হামলা গণহত্যাকারী জান্তা সরকার, উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সন্ত্রাসী আরাকান আর্মিকে পথ করে দেয় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর পরিকল্পিত গণহত্যা বাস্তবায়নের জন্য।

২০১২ সালে গঠিত হওয়া আরসার এই অপরিণামদর্শী হামলার ফলস্বরূপ, শুরু হয় পরিকল্পিত সেই “এথনিক ক্লিঞ্জিং” তথা নির্মম রোহিঙ্গা গণহত্যা। এই এক অভিযানেই ৩৬ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে শহীদ করার পাশাপাশি প্রায় ১৮ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এই জাতিগত গণহত্যা থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালেই প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসে এবং রচিত হয় এ শতাব্দীর মুসলিম নিধনের এক করুণ ইতিহাস।

যেভাবে মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁদে পা দেয় আরসা

মিয়ানমার জান্তা সরকার চাইছিলো ২০১৭ সালে কফি আনান কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগেই যেকোনো ভাবেই হোক রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতর্কিত করে দেয়া। এই লক্ষ্যে তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা “সা ইয়া ফা” আরসাকে নিজেদের ফাঁদে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা আরসার বিভিন্ন নেতার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা আরসার প্রধান আবু আম্মার জুনুনি এবং তাদের কথিত উস্তাদ খালিদকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

তারই ফলস্বরূপ, ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক গোয়েন্দাদের উস্কানিতে আরসা মিয়ানমার পুলিশের উপর তাদের সেই অপরিকল্পিত ও আনাড়ি আক্রমণ করে বসে। যেই আক্রমণে তারা কেবল ১২ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করতে সক্ষম হয়, আর অপরদিকে তাদের নিজেদের ৭৭ জন সদস্যই বেঘোরে প্রাণ হারায়।

এদিকে জান্তা সরকার এমন একটি আনাড়ি পদক্ষেপের জন্যেই অধীর অপেক্ষা করছিল, যাতে করে রোহিঙ্গাদের উপর তাদের পরিকল্পিত গণহত্যা চালানোর বৈধতা পাওয়া যায় এবং সেই সাথে কফি আনান কমিশনও যেন অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরপর তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘটনার মাত্র ৬ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে তাদের সেনাবাহিনীকে নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর লেলিয়ে দেয়, যা আধুনিক সেনা মোতায়নের ইতিহাসে বেশ বিরল। এ থেকে স্পষ্টই বুঝা যায়, আরসার সেই কথিত হামলা সম্পর্কে মিয়ানমার জান্তাবাহিনী (তাতমাদাও) পূর্ব থেকেই অবগত ছিলো এবং এটি তাদের পরিকল্পনার অংশই ছিলো।

আরসার সাথে মিয়ানমার সরকার ও জান্তা বাহিনীর সুসম্পর্কের প্রমাণ

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, আরসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আবুল কালাম সৌদি আরবে অবস্থানরত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত “উ কো কো লাট” এর সাথে বৈঠক শেষে ফটোসেশনে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়াও ভয়াবহ ব্যাপার হল, আরসার সব কয়টি সামরিক ক্যাম্পই মিয়ানমারের সামরিক ঘাঁটি গুলোর একদম আশেপাশেই অবস্থিত ছিল। অথচ সেই ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সামরিক বাহিনী আরসার বিরুদ্ধে তেমন কোন সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যায় নি। এই ব্যাপারটি মিয়ানমার জান্তা সরকার ও আরসার মধ্যে যে একটি গোপন সমঝোতা ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে তা প্রমাণ করে।

পথভ্রষ্ট আরসা যেভাবে স্বজাতির উপরই বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্ভরযোগ্য ও প্রথিতযশা আলিমদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে চলা পথভ্রষ্ট সংগঠন আরসা এভাবেই প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজ করে চলেছে। সেই ২০১৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আরসা নামক খারেজী চরিত্রের এই দলটি মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধ করার নামে মূলত স্বজাতির ওপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে।

আপনারা জানেন যে, আমাদের মাজলুম রোহিঙ্গা মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। দায়েশপন্থী এই আরসা বাংলাদেশের রিফিউজি ক্যাম্প গুলোতে আশ্রয় নেয়া শত শত রোহিঙ্গা মুসলিমকে প্রতিনিয়ত হত্যা করে চলেছে কেবলমাত্র তাদের দলভুক্ত না হওয়ার অপরাধেই। শুধু তাই নয়, তাদের খারেজী মতাদর্শের পক্ষে ফতোয়া না দেওয়ার অপরাধে শতাধিক বিখ্যাত রোহিঙ্গা আলিমে দ্বীনকেও তারা হত্যা করেছে অত্যন্ত ঘৃণ্য ও পৈশাচিক কায়দায়।

গত ৭ বছরে আরসা মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভাজনই সৃষ্টি করে গেছে। এসব অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভাজন সৃষ্টি করতে তারা প্রায় ১১০০-এর অধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। অথচ যাদের অধিকাংশই ছিলেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সম্মানিত উলামাগণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ, যারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের আরাকানে নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও আরাকানকে স্বাধীন করার পক্ষে কথা বলতেন ও জোর প্রচেষ্টা চালাতেন।

অপরদিকে আরসার এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড মূলত আমাদের জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত প্রকৃত মুজাহিদদের কাজকেই বাধাগ্রস্ত করছে, যাদের লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে আরাকানকে বিজয়ী করে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে থাকা মাজলুম রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়া।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরসার সহিংস কার্যক্রমঃ ২০১৭ সাল থেকে বর্তমান

২০১৭ সাল থেকে আরসা রোহিঙ্গা মাজলুম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও ত্রাস ছড়ানোর মাধ্যমে তাদের খারেজি চরিত্রের প্রমান দিয়ে আসছে। তাদের কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গা নেতৃত্ব ও আলিমদের হত্যা করে একটি নেতৃত্বশূন্য অবস্থা তৈরি করা, যাতে আরসার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে না পারে। আরসার এসব সহিংস অভিযানে এখন পর্যন্ত হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা নেতা, আলেমে দ্বীন এবং সাধারণ জনগণ প্রাণ হারিয়েছে।

রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড

শরণার্থী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য নেতাদের একজন ছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ, যিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (ARSPH)-এর চেয়ারম্যান ছিলেন, যিনি ছিলেন একজন আল্লাহভীরু মানুষ।

তিনি রোহিঙ্গা জনগণের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা (জুলুম) ও গণহত্যার প্রমাণাদি নথিভুক্ত করছিলেন এবং মিয়ানমারে নিরাপদে প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে।

২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, রোহিঙ্গাদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে তার নিজ অফিসে আরসার সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আরসার ৬জন সশস্ত্র ব্যক্তি মাস্টার মুহিবুল্লাহর অফিসে ঢুকে তাকে একাধিক রাউন্ড গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। পরবর্তিতে তার ভাই মাস্টার আরিফ উল্লাহ কেও তারা একই কায়দায় হত্যা করে, আর এই হত্যাকাণ্ড সরাসরি আরসার সামরিক প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশেই ঘটানো হয় বলে আমরা জানতে পারি। মাস্টার মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে আরসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নেতৃত্বকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

 

আরসার হাতে বিশিষ্ট আলিমদের রক্ত

১। শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল্লাহ (রাহিঃ) এর হত্যাকাণ্ড

শাইখুল হাদীস মাওলানা আব্দুল্লাহ (রাহিঃ), যিনি আরাকানের লুদাইং পশ্চিম পাড়া গ্রামের একজন বিশিষ্ট আলিম ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বড় ফকিহ এবং ইসলামের নানা শাস্ত্রে গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তি। রোহিঙ্গাদের মাঝে যিনি মুফতিয়ে আজম হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন।

আরসা তাকে বহুবার নিজেদের পক্ষে ফতোয়া দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল, প্রত্যেকবারই তিনি তাদের ভ্রান্ত প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আরসার কুখ্যাত ডাকাত উস্তাদ খালেদ নিজ হাতে তাকে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়, এসময় আরসা প্রধান আতাউল্লাহ জুনুনীও স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত ছিল।

২। মাওলানা হাশিম (রাহিঃ) এর হত্যাকাণ্ড

মাওলানা হাশিম (রাহিঃ), যিনি সেক্টর ০৪-এর আওতাধীন কুমিরখালি গ্রামের জামিয়া সামশুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। যিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের শিক্ষা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন ও দেখাতেন। তিনি আরব বিশ্বে অত্যন্ত সম্মানিত আলিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন যেখানে একজন ছাত্র দাওরা হাদিসের পাশাপাশি বার্মিজ কারিকুলামেও পড়াশোনা করতে পারতেন, যা রোহিঙ্গাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রোহিঙ্গা জাতির এই মহান ব্যক্তিকেও আরসা অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করে দেয়।

৩। মাওলানা হামিদ উল্লাহ (রাহিঃ) এর হত্যাকাণ্ড

মাওলানা হামিদ উল্লাহ (রাহিঃ) এমন একজন আল্লাহভীরু মুত্তাকী আলেম ও মুজাহিদ ছিলেন, যিনি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে মোল্লা ওমর (রাহিঃ) এর অধীনে জিহাদ করেছিলেন। তিনি ক্যাম্প ১৮-এ ইসলামি মাহাজের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার প্রজ্ঞা ও তাকওয়া রোহিঙ্গা সমাজের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। ক্যাম্প ১৮-এর মাদ্রাসায় নারকীয় হামলা চালিয়ে খারেজী মতাদর্শ লালনকারী আরসা মাওলানা হামিদ উল্লাহ এবং উনার সাথী অনেক আলিমকে একই সাথে শহীদ করে দেয়।

আরসার মাদক পাচার এবং ‘হালাল’ ফতোয়া

আরসার মাদক ব্যবসা

আরসা রোহিঙ্গা জনগণের মধ্যে মাদক পাচারের মাধ্যমে তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে বেশ অনেক বছর ধরেই। ২০১৭ সালের পর থেকেই ইয়াবা ব্যবসায় আরসার জড়িত থাকার প্রমাণ ক্রমশই সামনে আসতে থাকে। আরসা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে টেকনাফ এবং কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা পাচার করে থাকে।
এক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আরসাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। বিশ্বের অন্যতম বড় ইয়াবা চালানগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে আরাকান রাজ্যের মংডু এবং বুথিডং অঞ্চলে ৬.৯৬ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেটের যে চালানটি ধরা পড়ে, তার বড় একটি অংশ ছিল আরসা নিয়ন্ত্রিত। আরসার এই মাদক পাচার নেটওয়ার্ক শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং মিয়ানমারের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও ছড়িয়ে পড়েছে।

মুনাফার জন্য ‘হালাল’ ফতোয়া

আরসার নেতারা এবং তাদের তথাকথিত আলেমরা একটি ভুয়া “হালাল ফতোয়া” জারি করেছে। তাদের মতে, মাদক বিক্রি তাদের লড়াইয়ের সহায়ক এবং ইসলামে তা বৈধ। অথচ আমরা জানি যে, ইসলামী শরিয়ায় মাদক সম্পূর্ণরূপে হারাম এবং কুরআন ও হাদিসে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যে ব্যাপারে আপনারা সম্যক অবগত আছেন। আরসা এই ফতোয়ার অপব্যবহার করে মুনাফার জন্য ইসলামের উসূলকে বিকৃত করেছে।

আরসার মানব পাচার নেটওয়ার্ক

মাদক পাচারের পাশাপাশি আরসা মানব পাচারের সাথেও গভীরভাবে জড়িত। তারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য দেশে পাচার করার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবহার করছে। আরসা এই পাচার কার্যক্রম থেকে মুক্তিপণ আদায় করার জন্য প্রায়ই রোহিঙ্গাদের বিপজ্জনক নৌপথে পাঠিয়ে তাদের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

আরসার এই কার্যক্রমের ফলে এ পর্যন্ত প্রায় হাজারের অধিক নিরীহ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর সলিল সমাধি হয়েছে বঙ্গপোসাগরের তলদেশে। তাদের এই মানব পাচার মূলত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পরিকল্পনারই অংশ, কারণ আরসার এই কার্যক্রমের ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমরা আরাকান থেকে ব্যাপকহারে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

আরসার কর্মকাণ্ড আইএসআইএসের (খারেজিদের) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ

আরসা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য যে কৌশলসমূহ গ্রহণ করে থাকে, তার প্রায় সবগুলোই খারেজী আইএসআইএসের (দায়েশ) সন্ত্রাসী কৌশলের সাথে হুবহু মিলে যায়। খারেজীরা যেমন সাধারণ মুসলিমদের উপর নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয় এবং যারা তাদের মতামত গ্রহণ করে না, তাদেরকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে ফেলে। এক্ষেত্রে তারা কাফিরদের ছেড়ে দিয়ে মুসলিমদের হত্যা করাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করে।

আরসাও ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছে। আরসা এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বিশিষ্ট রোহিঙ্গা আলেম, নেতা এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে শুধুমাত্র তাদের মতামতের বিরোধিতা করেছিল বলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন…
“মাওলানা মোহাম্মদ হাশিম, মাওলানা জামাল, সুনা মিয়া, শওকত আলী, মাস্টার জাফর, আমান উল্লাহ, সৈয়দ নূর, আব্দুর রহিম, হাফিজ মাহবুব, হাফিজ সৈয়দ হোসেন, শফিক, মাস্টার হারুন (সাবেক চেয়ারম্যান), মাস্টার আয়াস, হাফিজ হুমায়ুন কবির, মাস্টার কবির আহমেদ (সাবেক চেয়ারম্যান), মাস্টার সালাহ আহমেদ। (সাবেক চেয়ারম্যান)”

আইএসআইএস-কে’র (দায়েশ খোরাসান শাখা) সাথে আরসার সংযোগ

আরসার আদর্শ এবং তাদের নেতাদের চিন্তাধারা

আরসার প্রধান কমান্ডার আতা উল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সৌদি আরবে বেড়ে ওঠেন। এসময় তিনি দায়েশের খোরাসানি গ্রুপের আদর্শে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে থাকেন, যা মূলত জামাতুল আহরার বা আইএসআইএস-কে (খোরাসান শাখা) নামে অধিক পরিচিত একটি খারেজি সংগঠন। আতা উল্লাহ এই গোষ্ঠীর সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেন এবং পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মালাকান্দ ডিভিশনে তিন মাসের প্রশিক্ষণও নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি আবারো সৌদি আরবে ফিরে যান।

২০১২ সালে আরাকানে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু হলে আতা উল্লাহ সৌদি আরবের হাইল শহরের কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় বাংলাদেশে আসে এবং সেখান থেকে আরাকান রাজ্যে চলে যান, এসময় সে ও আবুল কালামসহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি মিলে আরসা গঠন করেন। আতা উল্লাহর লালিত খোরাসানি গ্রুপের খারেজি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় আরসার আদর্শ। যারা মনে করে যে, যারা তাদের সমর্থন করে না তারা মুসলমান নয় বরং কাফির। সুতরাং তাদের হত্যা করাও ইসলামে বৈধ (তাদের রক্ত হালাল)। এছাড়াও তারা আরো বিশ্বাস করে যে, প্রয়োজনে মাদক বিক্রি করাও হালাল।

 

আইএসআইএস-কে’র (দায়েশ খোরাসান শাখা) প্রতি আনুগত্যের বাইয়াহ

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আরসা তাদের আনুগত্য (বাইআহ) আইএসআইএস-কে দিয়েছে। তবে এটি তারা একারণে গোপন রাখার চেষ্টা করছে যে, বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা জনগণের মধ্যে আইএসআইএস বা খারিজিদের প্রতি প্রবল ঘৃণা রয়েছে। এই ঘৃণার কারণে আরসা প্রকাশ্যে এই সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে চায় না।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো আরসার সমস্ত ক্যাম্প ও ঘাঁটি মিয়ানমার সেনাদের ক্যাম্পের ১–৫ কিমি ব্যাসার্ধের ভেতরে স্থাপিত, অথচ সাত বছরেও তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। যা পরিষ্কারভাবে জান্তার সঙ্গে আরসার গুপ্ত সম্পর্ক প্রমাণ করে।

২৫ আগস্টের গণহত্যার দায় অবশ্যই জান্তা বাহিনীর ওপর বর্তায়, কিন্তু এর মূল অজুহাত ও সুযোগ তৈরি করেছিল এই খারেজি আরসা। আবু আম্মার জুনুনির নেতৃত্বে চালানো অবিবেচক ও ষড়যন্ত্রমূলক হামলাই পুরো জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। লক্ষ রোহিঙ্গা আজ বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বন্দি, আরাকানে যারা রয়ে গেছে তারা নতুন করে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির হাতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

তাই ২৫ আগস্ট আমাদের শুধু জান্তার বর্বরতা নয়, আরসার বিশ্বাসঘাতকতাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ যারা আরসাকে ‘স্বাধীনতার সংগঠন’ বলে প্রচার করছে, তারা হয় অজ্ঞ, না হয় এই বিশ্বাসঘাতক শক্তির সহযোগী। রোহিঙ্গা জাতির মুক্তি আসবে কেবল তখনই, যখন বাইরের শত্রুর পাশাপাশি ভেতরের এই খারেজি শক্তিকেও প্রতিরোধ করা হবে।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore