উম্মাহর ভিত্তি ও ভ্রাতৃত্ব

আমরা কারা ? আমাদের পরিচয় কি শুধু দেশ, ভাষা, রঙ, জাতি? না, আমাদের আসল পরিচয় হলো আমরা মুসলিম, আমরা মুমিন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে ঘোষণা করেছেনঃ

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ

নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজুরাতঃ ১০)

এই আয়াত মুসলিম জীবনের মূলভিত্তি। এই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সকল সম্পর্কের চেয়েও দামী। রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, কিন্তু ঈমানের ভিত্তিতে তৈরি সম্পর্ক আল্লাহর কাছে চিরস্থায়ী।

ঈমানের ভিত্তিতে তৈরি ভ্রাতৃত্বকে রাসূলুল্লাহ ﷺ হাদিসে এক অসাধারণ উপমা দিয়ে বলেছেন,

مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ، مَثَلُ الْجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ، تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
“মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতিতে একটি দেহের ন্যায়। শরীরের একটি অঙ্গ কষ্ট পেলে পুরো দেহ জ্বরে আক্রান্ত হয় ও অশান্ত হয়ে পড়ে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৫৮০)

অর্থাৎ ফিলিস্তিনে মুসলিমের রক্ত ঝরলে, আরাকানে মুসলিমের ঘর পুড়লে, কাশ্মীর, উইঘুরে মুসলিম নির্যাতিত হলে—আমাদের বুকও কাঁপবে, আমাদের চোখও ভিজবে। তাদের কষ্টে আমরা কষ্ট পাবো, তাদের আনন্দে আমরা আনন্দিত হবো।

মুসলিম উম্মাহর এই ভ্রাতৃত্ব আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই। যেমন বদরের যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন সাহাবি অংশ নিয়েছিলেন। তাদের হাতে অস্ত্রের পাশাপাশি ঈমান ও ঐক্যের শক্তি ছিল প্রবল । ফলে আমরা দেখতে পাই এক হাজার কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হলো। এটি আমাদের শেখায়, উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব থাকলে সংখ্যার কমতি কোনো বিষয় নয়।

আমরা আরো দেখতে পাই, যখন ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে মুসলিমদের রক্তে ভাসিয়েছিল, তখন মুসলিমদের মাঝে কোনো ঐক্য ছিল না। বহুবছর পর সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহ. মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। আল্লাহ তাকে বিজয় দিলেন। ফলে আমরা দেখতে পাই জেরুজালেম মুক্ত হলো, মুসলিমরা তাদের হারানো সম্মান ফিরে পেলো।

আন্দালুসে (স্পেন) প্রায় ৮০০ বছর মুসলিমদের শাসনে ছিল। জ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতিতে তারা ছিল শীর্ষে। কিন্তু সেখানকার মুসলিমরা যখন নিজেদের মধ্যে বিভাজন শুরু হল, ছোট ছোট রাজ্য দখল করা নিয়ে মারামারি করলো তখন ক্রুসেডাররা একে একে পুরো আন্দালুস দখল করে নিল। মুসলিমদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেলো।

ইতিহাসের এই পাঠগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমরা বিজয়ী হবো। বিভাজন করলে নিজেরা ধ্বংস হয়ে যাবো।

আমাদের করণীয়:

১. ভ্রাতৃত্বকে অন্তরে ধারণ করা:
পৃথিবীর যেকোনো মুসলিমের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করা। যেকোনো মুসলিমের আনন্দকে নিজের আনন্দ মনে করা।

২. অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা:
সুদূর গাজায় যেতে না পারলেও তাদেরকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারি।

৩. মিডিয়া যুদ্ধ:
মিডিয়ায় পশ্চিমা ও হিন্দুত্ববাদী অপশক্তিদের প্রোপাগান্ডা মোকাবিলা করা। তাদের Narrative এর বিরুদ্ধে counter narrative তৈরি করা।

৪. নিকটবর্তী মুসলিমদের প্রাধান্য দেয়া:
আরাকানের মজলুমরা আমাদের প্রতিবেশী। তাদের জন্য কাজ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী ফিকহে নিকটবর্তী মজলুম মুসলিমদেরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। তাই আমাদের উচিত রোহিঙ্গাদের জন্য সত্যিকার অর্থে কাজ করা যা আমরা গাজাবাসীর জন্য করতে চাই।

৫. মতপার্থক্যকে মতবিরোধে পরিণত না করা:
মাযহাব, ভাষা, জাতি, আঞ্চলিকতায় পার্থক্য থাকলেও এগুলো যেন “মুসলিম” পরিচয়ের ঊর্ধ্বে না যায়।

সর্বোপরি উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব শুধুমাত্র একক স্লোগান নয়—এটি আল্লাহর নির্দেশ, ঈমানের দাবি এবং আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। রাসূল ﷺ বলেছেনঃ

لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
“তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করে।” (সহীহ বুখারীঃ ১৩)

আজ আমরা যদি গাজায়, কাশ্মীরে, আরাকানে, উইঘুরে নির্যাতিত ভাইবোনদের জন্য কিছু না করি তাহলে আমাদের ভ্রাতৃত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তাই আসুন, আমরা বদর থেকে শিক্ষা নেই, সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.) এর মতো ঐক্য গড়ি, আর আন্দালুসের মতো নিজেদের মধ্যে বিভাজন থেকে সতর্ক হই। মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে কথায় নয়, কাজে বাস্তবায়ন করি। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র ও উম্মাহ পর্যন্ত ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিই।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore