বাবরি মসজিদ ট্র্যাজেডিঃ ইতিহাসের কালো অধ্যায়

বাবরি মসজিদ ট্র্যাজেডিঃ ইতিহাসের কালো অধ্যায়

ভারতবর্ষে যখন মুসলিমরা নির্যাতিত হতে শুরু করলো তখন আমরা দেখেছি কিভাবে একের পর এক মসজিদ, মাদ্রাসা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ধ্বংস করেছে। সাহাবিদের সোনালী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত যে কতো মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে তার হিসাব আল্লাহই ভালো জানেন। ভারতের ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়া ধারাবাহিক সেই নৃশংসতার এক করুণ ইতিহাস! বুকের তপ্ত খুনে রচিত লাল ইতিহাস।

আসুন জেনে নেই কিভাবে বাবরি মসজিদ হিন্দুত্ববাদীরা দখল করে নিলো:

মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাবরি মসজিদের নির্মাণ:

১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবর ভারত বিজয় করে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিজয় ভারতের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে এবং সারা দেশে ইসলামের নিশান উড়তে থাকে। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বাবর ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা রাজ্যে মীর বাকি তাশকন্দি-কে গভর্নর নিযুক্ত করেন। সম্রাটের নির্দেশে গভর্নর মীর বাকি তাশকন্দি ১৫৩৮ সালে অযোধ্যা রাজ্যের ফয়জাবাদে এক খণ্ড পতিত জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সম্রাটের স্মরণে এর নাম রাখা হয় বাবরি মসজিদ।

হিন্দুত্ববাদীদের ষড়যন্ত্র:

ভারতে মুসলমানদের আধিপত্য একদমই সহ্য করতে পারছিল না সেখানকার উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। ক্ষোভ ও বিদ্বেষে তারা ছটফট করতে থাকে। মুসলমানদের রাজ্য জয়কে তারা তাদের সত্তার উপর আঘাত বলে মনে করে এবং মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা সকলে এক ছাতার নিচে এসে মুসলমানদের ক্ষতিসাধনের জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে।

এই ষড়যন্ত্র এক সময় ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৫০০ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদের জমিকে তারা রাম মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত বলে ঘোষণা করে এবং দেশজুড়ে এর প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে। উগ্রতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে তারা মসজিদ দখলের উদ্দেশ্যে একের পর এক হামলা চালায়। আল্লাহর ঘর মসজিদের সাথে এমন ধৃষ্টতা প্রদর্শনের পর তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং এলাকায় এলাকায় মিছিল বের করে।

১৮৮৫ সালে অযোধ্যার উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের লালসা পূরণ করতে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো তারা বাবরি মসজিদের দিকে তেড়ে আসে। সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে তারা মসজিদ প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। মুমিনদের হৃদয়ে তখন ঈমানের সুপ্ত শিখা জ্বলে ওঠে এবং আল্লাহর ঘরকে রক্ষা করতে তারা প্রতিরোধের ময়দানে ছুটে আসে। উগ্র হিন্দুসন্ত্রাসীদের সাথে তীব্র প্রতিরোধে অসংখ্য মুসলমান শাহাদাতবরণ করেন।

১৮৮৭ সালে হিন্দুরা পুনরায় বাবরি মসজিদের ওপর হামলা করে। মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদ চত্বরের কিছু অংশ দখল করে সেখানে রামপূজার ছোট বেদি নির্মাণ করে।

১৯৩৪ সালে সারা ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে পৃথিবী মুসলমানদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। এই কঠিন সময়ে হিন্দুরা পুনরায় বাবরি মসজিদের ওপর হামলা করে এবং মসজিদের দেয়ালের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে। এরপর ১৯৪৯ সালে মুসলিমদের জন্য চরম বিপর্যয়ের সময় নিয়ে আসে। হঠাৎ একদিন উগ্র হিন্দুরা বাবরি মসজিদে ঢুকে সেখানে রামের মূর্তি স্থাপন করে।

ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পর্যায়:

১৯৯২ সালের জুলাই মাসে নরসীমা রাওয়ের সময় বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে রাম মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। উগ্র হিন্দুদের প্রতিরোধ করতে মুসলমানরা সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে আবারও রক্তের খেলা শুরু হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে উগ্র হিন্দুরা বাবরি মসজিদকে সমূলে ধ্বংস করতে ঝাপিয়ে পরে । কিছু উগ্র হিন্দু যুবক বিধ্বস্ত মসজিদের ভবনে পেশাব করে।

এরপরই সারা ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন ও তার পরের দিন দাঙ্গায় ২৩৭ জন নিরীহ মুসলিম শহীদ হোন। এই দাঙ্গা আরো বেশ কয়েকদিন চলতে থাকে এবং এতে দুইহাজারেরও অধিক মুসলিম শাহাদাতবরণ করেন।

দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তদন্তের জন্য হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বে লিবারহান কমিশন গঠন করে। ১৬ বছর ধরে ৩৯৯টি বৈঠকের পর কমিশন ৩০ জুন ২০০৯ তারিখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০২৯ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। রিপোর্ট অনুসারে, ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ এর ঘটনাগুলি স্বতঃস্ফূর্ত বা অপরিকল্পিত ছিল না।

বিভিন্ন রায়ের পর বাবরি মসজিদের জমির বিষয়ে আদালত সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সব মুসলিমদের হতাশ করে ১৯৯২ সাল থেকে চলা এই ২৮ বছর পুরনো মামলায় একপক্ষিক রায় দেয়। সেই রায়ে সব অভিযুক্তকে নির্দোষ সাব্যস্ত করা হয়।

হিন্দুত্ববাদী বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদবের মতে, ঘটনাটি পূর্ব-পরিকল্পিত ছিল না এবং অভিযুক্তদের স্বপক্ষে নাকি পর্যাপ্ত প্রমাণও নেই। ফলে ৩২ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়:

এভাবেই বাবরি মসজিদ দখলে নিয়ে সেখানে শিরকের আখড়া বানিয়ে আল্লাহর সাথে বিদ্রোহের রাস্তা খুলে দেয় মোদির সরকার। এখনো সেখানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জুলুম আল্লাহর সাথে শিরক চলছে!! শুধু তাই নয়, ভারতের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানানোর পাঁয়তারা করছে সন্ত্রাসী বিজেপি সরকার! সেজন্য প্রশাসনকে দিয়ে মসজিদের জায়গাকে মন্দিরের জায়গা দাবি করে প্রতিনিয়ত মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এভাবে সমগ্র ভারতকে মসজিদশূন্য করার পায়তারা করছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি গোষ্ঠী।

উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে আমাদের ভোগবিলাস নিয়ে পরে থাকার সুযোগ নাই। এখনই সময় নিজেদেরকে মজলুমদের অভিভাবক হিসেবে গড়ে তোলা যাতে আমরা দ্রুতই বাবরি মসজিদ পুনরুদ্ধার করে সালাত আদায় করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore