ইসলাম ইনসাইট

১৯৮২ সালের হামা গণহত্যা: সিরিয়ার ইতিহাসে এক ভয়ানক অধ্যায়

১৯৮২ সালের হামা গণহত্যা: সিরিয়ার ইতিহাসে এক ভয়ানক অধ্যায়
১৯৮২ সালের হামা গণহত্যা: সিরিয়ার ইতিহাসে এক ভয়ানক অধ্যায়। ছবি : আল জাজিরা

১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সিরিয়ার ইতিহাসে এটি শোক ও বেদনার মাস—যা স্মরণ করে মানুষ আজও শোকবিহবহল হয়। এই মাসে হাফেজ আল-আসাদের নেতৃত্বে সিরিয়ার সরকার হামা শহরে ২৭ দিনব্যাপী এক নৃশংস পাশবিক গণহত্যা চালায়— যা ২৭ দিনব্যাপী এক ভয়াবহ গণহত্যায় রূপ নেয়। এই গণহত্যার পেছনে ছিল রাজনৈতিক বিরোধ, ক্ষমতার লড়াই এবং বিরোধীদের দমন করার এক নির্মম ও পাশব পরিকল্পনা।

এই প্রতিবেদন সেই ভয়াবহ গণহত্যার পটভূমি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এর প্রভাবের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরবে।

ক্ষমতা দখল, সংবিধান প্রণয়ন

১৯৭০ সালে হাফেজ আল-আসাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা সুসংহত করতে ১৯৭৩ সালে তিনি একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা তাকে কার্যত সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে। নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রের নির্বাহী, বিচার এবং আইন প্রণয়নকারী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় তার হাতে।

এই সংবিধানের বিরোধিতা করে হামা শহরে শুরু হয় ‘সংবিধান বিরোধী আন্দোলন’। বিক্ষোভের দায়ে সরকার বিরোধী নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তার করে। এই পরিস্থিতি থেকে সহিংসতার সূচনা ঘটে, যা পরবর্তীতে সশস্ত্র প্রতিরোধে রূপ নেয়।

তালিয়াহ আল-মুকাতিলাহ

সংবিধান বিরোধী আন্দোলন এবং সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় হামা শহরে ‘তালিয়াহ আল-মুকাতিলাহ’ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের উত্থান ঘটে। এই সংগঠনটি মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থনপুষ্ট ছিল। তারা সরাসরি সরকার এবং রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টার্গেট করে হামলা চালাতে থাকে।

১৯৭৯ সালের ১৬ জুন আলেপ্পো শহরের একটি সামরিক স্কুলে তালিয়াহ আল-মুকাতিলাহ একটি বড় আক্রমণ চালায়। আক্রমণে বহু আলাভি শিয়া সামরিক কর্মকর্তাকে নিহত হয়। এই ঘটনা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে। সরকার এর জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

হাফেজ আল-আসাদকে হত্যার প্রচেষ্টা

১৯৮০ সালের ২৬ জুন হাফেজ আল-আসাদকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এই ঘটনার জন্যও সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ী করে। এর প্রতিক্রিয়ায় তাদমুর কারাগারে আটক থাকা প্রায় ১,০০০ বন্দীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।

একই বছর একটি নতুন আইন জারি করা হয়। যে আইন মুসলিম ব্রাদারহুডে সদস্যপদ গ্রহণকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি কার্যত বিরোধীদের ওপর গণহত্যার আইনগত বৈধ ছাড়পত্র প্রদান করে।

১৯৮২ সালের হামা গণহত্যার সূচনা

১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে হামা শহরে সামরিক অভিযান শুরু হয়। সরকার বিদ্রোহ দমন করতে শহরটি পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে। শহরের পানি, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে । কারফিউ জারি করা হয় এবং শহরের চারপাশে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২
প্রথম সামরিক অভিযান শুরু হয়। সেনাবাহিনী শহরে ঢুকতে চেষ্টা করে, কিন্তু স্থানীয় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে। এরপর শহরের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা এবং ভারী অস্ত্র দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২
চতুর্থ দিনে স্থল অভিযান চালানো হয়। সৈন্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। বেসামরিক পুরুষ, নারী এবং শিশুরা কেউ এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।

গণহত্যার ভয়াবহতা, পরিসংখ্যান

নিহত: প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার বেসামরিক লোক।
নিখোঁজ: ১৭ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে মাত্র ৩,৭৬২ জনের তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে।
ধ্বংস: ৭৯টি মসজিদ, ৩টি গির্জা, এবং বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও চিকিৎসা কেন্দ্র।

শহরের অবস্থা: হামা শহর কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হাজারো মানুষ পালাতে বাধ্য হয়, আর যারা বেঁচে ছিলেন, তারা শহরের ধ্বংসাবশেষে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।

হামা গণহত্যা সিরিয়ার ইতিহাসে এক নির্মম এবং অন্ধকার অধ্যায়। এটি শুধুমাত্র একটি গণহত্যা নয়, বরং একটি গোটা জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রয়াস।

বাশারের পিতা হাফেজ আল-আসাদের শাসনামল এই ঘটনার জন্য চিরকাল কলঙ্কিত থাকবে। এই গণহত্যার ক্ষত আজও সিরিয়ার মানুষের মনে গভীরভাবে রয়ে গেছে।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore