ইসলাম ইনসাইট

মরক্কোর বিপ্লবী, ফিলিস্তিনের শহীদ আব্দুল আযীয আদ দাসের

মরক্কোর বিপ্লবী, ফিলিস্তিনের শহীদআব্দুল আযীয আদ দাসের
মরক্কোর বিপ্লবী, ফিলিস্তিনের শহীদআব্দুল আযীয আদ দাসের। ছবি : আল জাজিরা

১৯৮১ সালের ১ অক্টোবর। মরোক্কোর প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগঠনের অফিস এবং মরোক্কো প্যালেস্টাইন সংগ্রাম সমর্থনকারী অ্যাসোসিয়েশন একত্রে একটি শোক বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে মরোক্কোর শহীদ আব্দুল আযীয আদ দাসেরের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়; যিনি ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মরক্কোর এই সূর্যসন্তানের নাম ইতিহাসে লেখা আছে রক্তের অক্ষরে। কিন্তু কে ছিলেন এই আব্দুল আযীয আদ দাসের? কেনই বা তার নাম মরক্কোর সীমানা পেরিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের সাথে একাত্ম হয়ে গেল?

বিপ্লবী শৈশব, সংগ্রামী পরিবার

আব্দুল আযীয আদ দাসের জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালের ২৫ নভেম্বর, মরক্কোর ঐতিহাসিক সালা শহরে। এই শহরটি আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে, আবি রাকরাক সালা নদীর মোহনায় অবস্থিত। আব্দুল আযীয আদ দাসেরের পরিবার ছিল সুওয়াইরা শহরের অধিবাসী। সুওয়াইরা হচ্ছে সেই শহর, যার প্রতিটি ইট-পাথরে লেখা আছে ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গল্প। এই শহরটি ফরাসি আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে বারবার দেখিয়েছিল বীরল সাহস ও অনন্য প্রতিরোধের নজির। এই শহরটি আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত।

আন নাহদা বিদ্যালয়, চেতনার প্রথম পাঠ

মরোক্কোর প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রাম সমর্থনকারী অ্যাসোসিয়েশন এবং রাবাতে অবস্থিত প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগঠনের অফিস থেকে প্রকাশিত শোকবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আব্দুল আযীয আদ দাসের তার শৈশব ও কৈশোরের একটি অংশ কাটিয়েছেন আলজেরিয়ায়, যেখানে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরে তিনি ফিরে আসেন সালায় এবং ভর্তি হন আল নাহদা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। মুজাহিদ আবু বকর আল-কাদরি প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় শুধু শিক্ষার কেন্দ্রই ছিল না; এটি ছিল ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রতি মরক্কোর নতুন প্রজন্মের চেতনা জাগানোর সূতিকাগার। আন-নাহদা স্কুল আব্দুল আযীয আদ দাসেরের হৃদয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।

এখান থেকেই আব্দুল আযীয আদ দাসেরের মনে ফিলিস্তিনের প্রতি গভীর প্রেম জাগে। বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সাথে মিলে তিনি ফিলিস্তিনের জন্য কাজ শুরু করেন। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন।

শোকবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি নিজেকে ফিলিস্তিনি বলে মনে করতেন। ফিলিস্তিনের জন্য লড়াই করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তিনি ১৯৮১ সালের শুরুর দিকে পড়াশোনা ছেড়ে ফিলিস্তিনী বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন।

ছাত্র আন্দোন থেকে রণাঙ্গন

আব্দুল আযীয আদ দাসের জনকল্যাণমূলক একটি সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সংগঠনটি ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে ম্যাগাজিন, কুফিয়া (ফিলিস্তিনি স্কার্ফ), এবং বিপ্লবী গানের ক্যাসেট বিক্রয় করত। সেইসঙ্গে তারা সেমিনার ও আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ফিলিস্তিনের বার্তা পৌঁছে দিত।

রাবাতের আইন কলেজে পড়াশোনা শেষে আব্দুল আযীয আদ-দাসের বাগদাদে যান এবং ১৯৭৯-৮০ সালে জামেয়া বাগদাদ (বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে আইন ও রাজনৈতিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি ফিলিস্তিনি ছাত্রদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যা তার মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আরও প্রবল আগ্রহ তৈরি করে। এই সময় থেকেই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনের মুক্তি।

১৯৮১ সালে আব্দুল আযীয আদ-দাসের এক নতুন সংগ্রামের পথে পা বাড়িয়ে ফিলিস্তিনের প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে, লেবাননে ফিলিস্তিনি বিপ্লবের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন।

বিপ্লব, রক্তাক্ত বিদায়

ফিলিস্তিনী বিপ্লবে যোগ দেওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর ১৯৮১ সালের ১ অক্টোবর বৈরুতের ফাকিহানী অঞ্চলের ফিলিস্তিনী বিপ্লবী কার্যালয়ে একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্র ছিল বলে অভিযোগ করা হয়।

বিস্ফোরণটি আফিফ তায়েবি সড়কে ঘটেছিল। বিস্ফোরণে সেখানকার বহু ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ শাহাদাত বরণ করেন। সেই রক্তাক্ত দিনের শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয়েছিল আব্দুল আযীয আদ-দাসেরের নাম।

এভাবেই রক্তের অক্ষরে লেখা এক অধ্যায়ের মাধ্যমে আব্দুল আযীয আদ-দাসের সংক্ষিপ্ত এবং সমৃদ্ধ সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা তার সংগ্রামের গল্প আজও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore