“জিহাদ” এমন একটি শব্দ, যা শুনতে অনেকের কাছেই খুব ভীতিকর লাগে। অন্যভাবে বললে – মিডিয়ার মাধ্যমে এই জিহাদ শব্দটিকে আমাদের কাছে অত্যন্ত ভীতিকর করে তুলে ধরা হয়েছে।
তবে কথা হল – মুসলিম হিসেবে আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি জিহাদ আসলে কি❓জিহাদ হল ইবাদাত। জুলুম ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করে দিয়ে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের উপর ফরজ করেছেন এই জিহাদ।
শুধু কি তাই? দুনিয়াব্যাপী সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করার মাপকাঠি এবং মিথ্যার উপর সত্যের বিজয়ী হওয়ার চাবিকাঠিও এই জিহাদ। জিহাদ ব্যতীত মুসলিমদের বিজয় যেমন কল্পনাতীত, ঠিক তেমনি জিহাদের আমল ছেড়ে দিলে জুলুমের ভয়াবহতা নেমে আসাটাও খুব স্বাভাবিক।
ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এটাই বলে যে – ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সভ্যতা বিনির্মাণেরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে এই মহান ইবাদাত জিহাদের। এছাড়াও ইতিহাস আমাদের বলে দেয় – কিভাবে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অজস্র ও অগণিত কল্যাণ ও উন্নয়নের জোয়ার বয়ে নিয়ে এসেছে এই জিহাদ।
আমরা এখন উন্নত চিকিৎসা পেতে হাসপাতালে যাই। কিন্তু আমরা ক’জনই বা জানি যে, হাসপাতালের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সূচনাও হয়েছে মুসলিমদের হাত ধরেই? জিহাদের আমলকারী আহত মুজাহিদ ও জনসাধারণের চিকিৎসা ও সুস্থতার স্বার্থে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পদ্ধতি সম্বলিত একটি আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন আহমদ ইবনে তুলুন। তিনি ছিলেন তুলুনিদ সাম্রাজ্যের একজন শাসক। আহমদ ইবনে তুলুন ৮৭২ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে ‘আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও নবম শতকে তিউনিসিয়ায়ও একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেসময়ে মুসলিমদের তৈরি সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব হাসপাতাল ছিল ৯৮২ সালে বাগদাদের শাসক ওয়াদুদ আল ওয়ালিদ এর নির্মিত হাসপাতালটি। পরবর্তীতে হাসপাতাল ব্যবস্থার ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়াও আহত মুজাহিদদের সুচিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রচলন হয় সার্জারি ও অন্যান্য বড় বড় অপারেশনের। আর পৃথিবীর ১ম বিশেষজ্ঞ সার্জন ও শল্যচিকিৎসক ছিলেন আবুল কাসিম আল-জাহরাভি(৯৩৬-১০১৩)। তার রচিত ৩০ খন্ডের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ্বকোষ ‘আল-তাদরিফ’-এর একটি খন্ডই রয়েছে ‘সার্জারি বা অস্ত্রোপচার’ নামে। তাকে আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়।এছাড়াও দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রখ্যাত আলিম, আবিষ্কারক ও বিজ্ঞানী ইসমাইল আল জাজারি রহঃ যুদ্ধে আহত মুজাহিদদের সেবা করতে গিয়ে রক্ত পরিমাপক ডিভাইস আবিষ্কার করেন। এছাড়াও যুদ্ধে পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিরন্তর গবেষণা করে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন পানির পাম্প।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। আর বিশ্ববিদ্যালয় হল শিক্ষা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিষ্ঠান। এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সাথেও মিশে আছে জিহাদ। মুসলিম সন্তানদের কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে জিহাদের ময়দানের যোগ্য সিপাহসালার করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেলজুক সাম্রাজ্যের মহান উজির, যুদ্ধের সেনানায়ক ও প্রসিদ্ধ আলিম নিজামুল মূলক যে নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তার পাঠপদ্ধতির অনুসরণ ও অনুকরণ করেই আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা। এছাড়াও শিয়াদের ছড়ানো ভ্রান্ত বাতিনী আকীদার বিষাক্ত চক্রান্ত দমনেও এই নিজামিয়া মাদ্রাসার অবদান ছিল অবিস্মরনীয়।
মানুষ চায় অন্যায় ও জুলুমের শিকার না হতে, কিন্তু মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে জিহাদের হুকুম আসার আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর মানুষ ছিল অন্য মানুষের দাস। জুলুম ও নির্যাতন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। যখনই মুসলিমরা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে জিহাদের আমল করতে শুরু করলো, ঠিক তখন থেকেই পৃথিবীবাসী চিরমুক্তি ও প্রশান্তির দেখা পেলো। জিহাদের আমলের বদৌলতেই মুসলিমরা একের পর এক ভূখণ্ডে জালিম ও অত্যাচারীদের অন্যায় ও জুলুমকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধু কি মুসলিমরাই জিহাদের সুফল পেয়েছে? অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী কি জিহাদের সুফল ভোগ করে নি? এর উত্তর হল – জিহাদের সুফল পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠীই ভোগ করেছে আনন্দচিত্তে।
আমরা কি মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ইতিহাস জানি? ইসলামের মহান সেনাপতি মুসা বিন নুসায়ের সদ্য আফ্রিকা বিজয় করলেন। মুসলিমদের অসাধারণ ব্যবহার ও ইসলামের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগলো। একদিন পার্শ্ববর্তী দেশ স্পেন থেকে একজন নির্যাতিত খ্রিষ্টান এলেন মুসার কাছে, নাম তার হুলিয়ান। যার অতি আদরের মেয়ের সম্ভ্রম হরণ করেছিল স্পেনের জালিম ও চরিত্রহীন রাজা রডারিক। তিনি মুসার কাছে এই অত্যাচারের বিচার চাইলেন এবং অনুরোধ করলেন তিনি যেন জালিম শাসক রডারিককে শাস্তি দিয়ে স্পেনের নির্যাতিত মানুষদের মুক্ত করতে সেখানে মুসলিম সেনাবাহিনী পাঠান। এই ঘটনার পরই পৃথিবী বিখ্যাত মুসলিম বীর সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিমরা স্পেনে অভিযান প্রেরণ করে এবং বিজয় অর্জন করে।
জিহাদের আমল করতে গিয়ে ১০০০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত এই ২০০ বছরে মুসলিম সমরবীদরা যুদ্ধবিদ্যাকে এক নতুন যুগে প্রবেশ করান। তাদের লেখা যুদ্ধবিদ্যার অসামান্য বইগুলো ছিল ৩ ধরণের। প্রথমটি ছিল ফুরুসিয়া, যা ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বিতীয়টি তীর ও ধনুকবিদ্যা এবং তৃতীয়টি সামরিক সংগঠন ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রবিষয়ক। এই তিন বিষয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বই হলো সুপরিচিত মুসলিম বীর নাযম আল-দীন আইয়ুব আল আহদাব হাসান আল রাম্মাহ (ইন্তেকাল হিজরি ৬৯৪, ১২৯৫ ঈসায়ি) রচিত ‘আল ফুরুসিয়া বিরাসসম আল জিহাদ’।
সমরনীতির উপর মুসলিমদের এই অবদান এটাই প্রমাণ করে সে – সে সময়ের মুসলিমরা আমাদের মত সমরবিদ্যাহীন ভোঁতা মানুষ ছিলেন না। বরং তারা ছিলেন সংগঠিত, সাহসী ও প্রয়োজনীয় আধুনিক সমরাস্ত্রে পর্যাপ্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত। আর এজন্যই তারা সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেটা আমরা পারছিনা বর্তমান সময়ের মুসলিমরা। আমরা তো বরং জিহাদের মত মহান ইবাদাতকে বাদ দিয়ে ফেলেছি আমাদের সারা জীবনের আমল থেকেই। আর এ কারণে আমরা আজ পরাজিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত। অথচ আমাদেরই পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সমরবিদ্যায় গবেষণারত কাফির, মুশরিক ও ইহুদীরা আজ বিশ্বজয়ী।
 
								 
								 
															