আমরা সকলেই জানি, খাগড়াছড়িতে কী ঘটেছে, কী ঘটছে এবং কী ঘটতে চলেছে। কিছুদিন পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো না কোনো এলাকায় ঘটে যাচ্ছে নতুন কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কখনো সন্ত্রাসীরা মোবাইল টাওয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে, কখনো বাঙালি মুসলিমদের অপহরণ করছে, ডাকাতি করছে, ধর্ষণ করছে, এবং এলাকায় ভয়ঙ্কর রাহাজানি চালাচ্ছে। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দ্বারা ঘটছে না।
অন্যদিকে আমরা অনেকেই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চিন্তিত। আট বছর পার হয়ে গেছে, অথচ এই সংকটের কোনো সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। এক্ষেত্রে অনেকেই ভারতীয় ঘরানার কিছু দালাল মিডিয়ার অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে ভাবেন যে – রোহিঙ্গারাই বাংলাদেশে থেকে যেতে চায়। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই দুই সমস্যার (পার্বত্য অশান্তি এবং রোহিঙ্গা সংকট) মূল নেপথ্যে রয়েছে একটি সুসংগঠিত চক্র, যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও এদেশের মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত…
(ক) স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন: UPDF, JSS, KNF এবং তাদের মদদদাতারা
এই গোষ্ঠীগুলো বহুদিন ধরে পার্বত্য এলাকায় অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে স্বঘোষিত দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই, বরং তারা সরাসরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকল্প হিসেবে নিজস্ব সন্ত্রাসী কাঠামো গড়ে তুলেছে।
(খ) সন্ত্রাসী ড্রাগ-মাফিয়া ‘আরাকান আর্মি’ (AA)
মিয়ানমারের একাংশ নিয়ন্ত্রণকারী এই সন্ত্রাসী সংগঠন প্রকাশ্যে “আন্দোলন”-এর কথা বললেও, বাস্তবে তারা হচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাদক কার্টেল, যারা ইয়াবা, আইস, অস্ত্র, এবং রক্তের মাধ্যমে একটি মাফিয়া অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।
(গ) হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা
ভারতের বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করার স্বপ্নে বিভোর। শেখ হাসিনা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় প্রক্সি, যে কিনা বাংলাদেশের ভেতরেই ভারতের স্বার্থরক্ষায় কাজ করত। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনে এই তিন গোষ্ঠী যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
কেননা, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চাঁদাবাজি সীমিত হয়ে পড়েছে। ভারত হারিয়েছে তার প্রিয় দাসীকে,আর আরাকান আর্মি হারাচ্ছে মাদক পাচারের সেই নিরাপদ করিডোর, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে ইয়াবা ছড়িয়ে দিয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করত।
ফ্যাসিস্ট আমলে ড্রাগের রাজনীতি ও আরাকান আর্মির মুনাফা
এই সময়েই ‘ইয়াবা বদি’ ও তার মতো অনেকেই আরাকান আর্মির সরবরাহ করা ড্রাগ বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গিয়েছিল। সেসব দিন এখন আর নেই। বিজিবি ও সেনাবাহিনী যখন এই ড্রাগ রুট বন্ধ করার চেষ্টা শুরু করে, তখনই আরাকান আর্মি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা শুরু করে। এখন তারা স্পষ্টভাবে একটি মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির মহাপরিকল্পনাঃ
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ অস্থিতিশীল করে তোলা
বর্তমানে খাগড়াছড়িতে যা ঘটছে তা এই পরিকল্পনারই অংশ। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের চীন-স্টেইট এর পেলাতুয়া থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিপুল অস্ত্র মজুদ করেছে [ বর্ডার পিলার ৬৯-৭০] । এই অস্ত্র তারা সরবরাহ করছে UPDF, JSS-এর মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে। এই অস্ত্র যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তবে পুরো পার্বত্য অঞ্চল একটি উত্তপ্ত যুদ্ধাঞ্চলে পরিণত হবে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত সময় ক্ষেপন না করেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অতিরিক্ত সেনা ও বিজিবি মোতায়েন করে একটি সর্বাত্মক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করা এবং আরাকান আর্মির সকল সহযোগী ও কোলাবোরেটরদের নির্মূল করে দেওয়া।
(২) রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন গণহত্যার প্রস্তুতি
বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে আরাকান আর্মি নিয়মিতভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে এখন পর্যন্ত তিন-চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং ১৮-২২ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
কিন্তু তাতেও আরাকান আর্মির তৃষ্ণা মেটেনি। তারা আবারও একটি ভয়াবহ গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আরাকানে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের হয় বাংলাদেশে ঠেলে দিতে, নয়তো সম্পূর্ণরূপে হত্যা করতে পরিকল্পিত অভিযান পরিচালনা করছে।
যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়, তবে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানে ফিরে যাওয়ার রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, এবং বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য তা হবে এক চিরস্থায়ী সংকট।
আরাকান আর্মি কীভাবে সরাসরি বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে উঠছে?
(০১) সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলা একটি বিদেশি ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে
সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির ছাত্র সংগঠন [আরাকান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন] , পাহাড় থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি তুলছে। এই অবস্থান স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি।
(০২) রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার
যখনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি আরাকান আর্মির মাদক পাচার রুটে অভিযান চালায়, তখনই তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করে। এটাই প্রমাণ করে যে, এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভয়াবহ চক্রান্তে লিপ্ত।
(০৩) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যাহত করার ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের নিজ ভূমি আরাকানে ফিরে যাক। অথচ আরাকান আর্মি এই রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চালিয়ে তাদের অস্তিত্বই মুছে ফেলতে চায়, যাতে তারা আর কখনও ফিরে যেতে না পারে। এর ফলে বাংলাদেশ একটি স্থায়ী মানবিক ও কূটনৈতিক সংকটে পড়ে যাচ্ছে।
তাই এখনই প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ ও জনমত গঠন করা। এক্ষেত্রে আমরা যা করতে পারি…
(ক) সরকারকে আর অপেক্ষা না করে শক্ত হাতে এগোতে হবে।
(খ) সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে পাহাড় ও সীমান্তে সন্ত্রাস নির্মূলের টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
(গ) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আরাকান আর্মির আসল রূপ উন্মোচন করতে হবে।
(ঘ) আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানাতে হবে, আরাকান আর্মিকে একটি আন্তর্জাতিক মাদক-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আরাকান আর্মি কোনো জাতিগত মুক্তি বাহিনী নয়। বরং তারা একটি ভয়াবহ ড্রাগ-মাফিয়া ও রক্তচোষা সন্ত্রাসী কার্টেল, যারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ধ্বংসের লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। এখন সময় এসেছে পদক্ষের নেয়ার, আমাদের মাতৃভূমির সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আর কোন ছাড় নয়।