ইসলাম ইনসাইট

আরব বসন্তের মাধ্যমে যেসব প্রেসিডেন্ট উৎখাত হয়েছেন

আরব বসন্ত ও বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হয়েছেন যেসব প্রেসিডেন্ট
আরব বসন্ত ও বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হয়েছেন যেসব প্রেসিডেন্ট। ছবি: আল জাজিরা

আরব ও ইসলামিক বিশ্বের ইতিহাসে বিপ্লব এবং প্রতিবাদের গতি কখনো থেমে থাকেনি। তবে বিশেষভাবে ২০১১ সালের আরব বসন্ত বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে জনগণের প্রতিবাদ ক্ষমতাশালী নেতাদের শাসন থেকে সরিয়ে দিতে পারে। প্রথমে তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত সারা আরব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদকারীরা বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্টদের শাসনব্যবস্থা, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলস্বরূপ একের পর এক প্রেসিডেন্টকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করাতে সক্ষম হয় তারা। আরব বসন্ত ও তার পরবর্তীতে স্বৈরশাসকের উৎখাতের ঘটনাবলীর মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রেসিডেন্ট উৎখাতের ইতিহাস এখানে তুলে ধরা হলো—

বাশার আল আসাদ (সিরিয়া)

বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে তিনি সিরিয়ার ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের নামে কিছু পদক্ষেপ নেন। যেগুলো অনেকটা উপেক্ষিত ছিল। এরপর ২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাব সিরিয়াতেও পৌঁছায়। ফলে জনগণ সেদেশে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। আসাদ সরকার এই আন্দোলন দমনে সহিংসতার পথ বেছে নেয়, যা পরবর্তীতে একটি গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। ১৪ বছরের দীর্ঘ এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা দামেশকে প্রবেশ করে তা দখল করে। আর এরই মধ্য দিয়ে আসাদ সরকারের পতন ঘটে।

ওমর আল বশির (সুদান)

ওমর আল বশির ১৯৮৯ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের ক্ষমতায় আসেন। তার শাসনামলে সুদানে অনেক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এরপর ২০১৮ সালে সুদানে আর্থিক সংকট এবং মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণ প্রতিবাদ শুরু করে। ২০১৯ সালে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং ৬ এপ্রিল নাগাদ সুদানের জনগণ সেনাবাহিনীর কাছে সাহায্যের আবেদন করে। সেনাবাহিনী বশিরকে উৎখাত করে এবং তাকে আটক করে। আন্তর্জাতিক আদালত তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ ওঠে।

আলি আবদুল্লাহ সালেহ (ইয়েমেন)

আলি আবদুল্লাহ সালেহ ১৯৭৮ সালে ইয়েমেনের উত্তর অংশে প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ইয়েমেনের দক্ষিণ অংশের সাথে একত্রীকরণের পর পুরো ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সালেহ ২০১১ সালে আরব বসন্তের প্রভাবে ইয়েমেনে একাধিক আন্দোলনের মুখে পড়েন। আস্তে আস্তে তার শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ গতি পায়। এরপর ২০১২ সালে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ২০১৭ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে তিনি নিহত হন।

মুআম্মার আল গাদ্দাফি (লিবিয়া)

মুআম্মার আল কাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেন । তার শাসনকালে, লিবিয়ার জনগণ রাজনৈতিক নিপীড়ন, দুর্নীতি এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। ২০১১ সালে লিবিয়ায় জনগণ বিদ্রোহ শুরু করলে গাদ্দাফি সরকার কঠোরভাবে দমনপীড়ন শুরু করে। ফলে, দেশটি একটি গৃহযুদ্ধে দিকে ধাবিত হয়। ৮ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের পর গাদ্দাফি ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে নিহত হন।

যাইন আল আবদীন বিন আলি (তিউনিসিয়া)

যাইন আল আবদীন বিন আলি ১৯৮৭ সালে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট হাবিব বোরকিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। বিন আলি তার শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বৈরাচারিতা এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন চালান। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিউনিসিয়ার একজন প্রতিবাদী তরুণ মোহাম্মদ বিন আজিজ আত্মহত্যা করেন। যা পরবর্তীতে তিউনিসিয়ায় ব্যাপক আন্দোলনের জন্ম দেয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বিন আলি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চরমে পৌঁছালে তিনি ১৪ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

হোসনি মুবারক (মিশর)

হোসনি মুবারক ১৯৮১ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট হন। ৩০ বছর ধরে তিনি মিশর শাসন করেন এবং দেশটির আর্থিক উন্নতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনর্বহাল করতে চেষ্টা করেন। তবে, তার শাসনামলে জনগণের মধ্যে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন বেড়ে যায়। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মিশরে আরব বসন্তের ঢেউ পৌঁছালে জনগণ অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে উত্তরণ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৮ দিনব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মুবারক পদত্যাগ করেন। তাকে পরবর্তীতে হত্যা মামলার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। যদিও ২০১৭ সালে তিনি বেশিরভাগ অভিযোগ থেকে খালাস পান।

শাহ মোহাম্মদ রেজা পহলভি (ইরান)

শাহ মুহাম্মদ রেজা পহলভি ১৯৪১ সালে ইরানের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে ইরানে অনেক আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও তার শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ ও বিরোধিতার সূচনা হয়। পরে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের ফলে পহলভি সরকার পতিত হয় এবং আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের শাসক হন। পহলভি ইরান ছেড়ে মিশরে পালিয়ে যান
এবং সেখানে ১৯৮০ সালে তার মৃত্যু হয়।

আরব বিশ্ব ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এভাবে জনরোষের মুখে স্বৈরাচারদের দেশ ছেড়ে পালানোর ইতিহাস রয়েছে। এর নিকটবর্তী উদাহরণ হলো আমাদের দেশের স্বৈরাচার হাসিনার ভারতে পলায়ন।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore