ইসলাম ইনসাইট

সিরিয়ার কিংবদন্তি অশ্বারোহী আদনান কাসসার

সিরিয়ার কিংবদন্তি অশ্বারোহী আদনান কাসসার
সিরিয়ার কিংবদন্তি অশ্বারোহী আদনান কাসসার। ছবি : সংগৃহীত

আদনান কাসসার ছিলেন ১৯৯২ সালে সিরিয়ার জাতীয় অশ্বারোহন দলের ক্যাপ্টেন। দামেশকের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া আদনান ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ার প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করতেন। তাদের পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘোড়ার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ধরে রেখেছে। এমনকি দামেশকের বিখ্যাত দিমাস অশ্বারোহন ক্লাব প্রতিষ্ঠায়ও এই পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আদনান ছিলেন একজন দক্ষ অশ্বারোহী, যিনি ১৯৯১ সালে বালকান চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত মডিটেরানিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক লাভের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয়-আন্তর্জাতিক অশ্বারোহন ক্রীড়াপ্রতিযোগীতায় অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও আদনান শিক্ষাগত দিক থেকে ব্রিটেনে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন, যা তার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রহের পরিচয় বহন করে।

আদনানের সঙ্গে ক্লাবে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন বাসেল আল-আসাদ, সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদের বড় ছেলে। তবে বাসেল ঘোড়া ও অশ্বারোহনে খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। তবুও তিনি নিজেকে দলের ওপর চাপিয়ে দিতে শুরু করেন। নিজেকে পাকা অশ্বারোহী প্রমাণ করার প্রয়াসে বাসেল দলের কার্যক্রমে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করতেন। এমনকি কোন ধরনের ঘোড়া কেনা হবে—এই সিদ্ধান্তগুলোতেও তিনি প্রভাব বিস্তার করতে চাইতেন। এমন পরিস্থিতি আদনানের জন্য ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। দলের নেতৃত্ব ও কার্যক্রমে বাসেলের একরোখা মনোভাবের কারণে তাঁদের মধ্যে গভীর মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। আদনান তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে দল পরিচালনা করতে চাইলেও বাসেল প্রতিনিয়ত বাধা সৃষ্টি করতেন। এই মতবিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি আদনানের জন্য ছিল অত্যন্ত নির্মম।

উইকিপিডিয়া (আরবী) এর তথ্যমতে, ক্যাপ্টেন আদনান কাসসার এবং বাসেল আল-আসাদের মধ্যে বিরোধ ১৯৯৩ সালের মডিটারেনিয়ান গেমসে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সেদিন প্রতিযোগিতা ছিল খুবই কঠিন। ঘোড়সওয়ারী খেলায় নিয়ম হচ্ছে, দলগতভাবে পয়েন্ট সংগ্রহের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হয়। বাসেল সেদিন বেশ কিছু ভুল করেছিল, যার ফলে দলের পয়েন্টে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। অন্যদিকে, আদনান তার পর্যায়ে কোন ভুল করেননি এবং দলের পয়েন্ট বাড়াতে সক্ষম হন, ফলে সিরিয়ান দল বিজয়ী হয়। এই কারণে আদনান কাসসার সেদিন বাসেল আল-আসাদ থেকে ক্যাপ্টেইনের সাইন লাভ করেন। কিন্তু এর পরে বাসেল তার ব্যর্থতার জন্য লজ্জিত না হয়ে, আদনান ও দলের প্রতি আরও অপমানজনক মনোভাব প্রকাশ করতে থাকে।

এক বছর পরের ঘটনা। আদনান সেদিন ক্লাবে ছিলেন। বাসেল আল-আসাদের রিং থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার হাতে ছিল একটি ব্যাগ যা তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ভরা। কিছু সময় পর হঠাৎ নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করে।

তদন্তের সময় যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ব্যাগটি তার কিনা— তখন তিনি হ্যাঁ বলে জানিয়েছিলেন। এরপর ব্যাগটি খুলে দেখা যায় যে, সেটি বিস্ফোরক দিয়ে ভর্তি ছিল। আদনানকে বাসেল আল-আসাদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এবং তার গাড়িতে বিস্ফোরক রাখার অভিযোগে আটক করা হয়। তাকে সাইদনায়া কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ১১ মাস থাকতে হয়, এবং সেখানে তাকে ‘আল-বাবুল আসওয়াদ’ তথা ‘ব্ল্যাকডাের’ নামে একটি বিচ্ছিন্ন সেলে রাখা হয়েছিল। যদিও তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি, কিন্তু তদন্তের সময় তাকে বলা হয়েছিল, ‘আমরা তোমার সাথে সম্পর্কের কারণে মাস্টারের কাছে যাব।’

এরপর বাসেল আল-আসাদ তাকে একটি বার্তা পাঠান, যাতে লেখা ছিল—
‘তুই যা করেছিস, তা অত্যন্ত গুরুতর একটা বিষয় ছিল। কিন্তু আমাদের মাঝে ‘রুটি ও লবণের সম্পর্ক’ না থাকলে, আমি তোকে আল-আব্বাসিয়েন চত্বরে মৃত্যুদণ্ড দিতাম। তবে, আমি তোর মৃত্যুদণ্ড মাফ করছি।’

তাঁকে অন্যায়ভাবে কারাগারে পাঠানো হয়। একজন প্রতিভাবান অশ্বারোহীর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথ এখানেই বন্ধ হয়ে যায়। আদনানের গল্প যেন একটি উজ্জ্বল তারার নিভে যাওয়ার মতো করুণ পরিণতি নিয়ে শেষ হয়। সিরিয়ার সেই ঘোড়দৌড় চ্যাম্পিয়ন এবং সিরিয়ার জাতীয় অশ্বারোহী দলের অধিনায়ক আদনান কাসসার— তাকে শুধুমাত্র ২১ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছিল, কারণ তিনি রাষ্ট্রপতির ছেলে বাসেল আল-আসাদকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতায় পরাজিত করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির ছেলের মৃত্যুর পরও, আদনান কাসসার জানতেন না যে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর জানাজানি হয় পাঁচ বছর পর। প্রতিবছর যখন মৃত্যুবার্ষিকীর সেই দিনটি আসত, তখন তাকে বন্দীখানার বাইরে বের করে এনে শারীরিক নির্যাতন করত কারারক্ষীরা, যেন ওই দিনে তার শাস্তি আরও তীব্র হয়। বাশার আল-আসাদ তার পরিবারকে বলেছিল, ‘সে শুধু আমার আদেশে মুক্তি পাবে।’

এভাবেই শুরু হয়েছিল এক মর্মান্তিক যাত্রা, যা এক ব্যক্তি এবং তার দেশপ্রেমের গল্পকেও একটি দুঃখজনক পরিণতিতে পরিণত করে। আদনান কাসসার ২১ বছর কারাগারে অবস্থান করেন। একুশ বছরে তিনি বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তরিত হন। ১৯৯৪ সালে বাসেল আল-আসাদ এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকে প্রতিবছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে, কারারক্ষীরা আদনান কাসারকে বের করে এনে শারীরিক নির্যাতন করত। ২০১৪ সালে বাশার আল-আসাদ তাকে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দেন।

আদনান কাসসারের জীবনের গল্প একদিকে প্রতিভা, দেশপ্রেম এবং সাফল্যের, অন্যদিকে মর্মান্তিক ষড়যন্ত্রের। তার জীবনের এই দুঃখজনক অধ্যায় প্রমাণ করে, প্রতিভা কখনো কখনো শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore